সকল মেনু

রোহিঙ্গা দমনে দক্ষিণ এশিয়ায় জোরালো হচ্ছে জঙ্গিবাদ বিস্তৃতির আশঙ্কা

46d1a74ebd26042df8a9dee5c720d85d-584961073a6d6আন্তর্জাতিক ॥ হটনিউজ২৪বিডি.কম : রাখা্ইন রাজ্যে চলমান জাতিগত নির্মূলপ্রক্রিয়া নিয়ে ক’দিন আগেই মিয়ানমারকে সতর্ক করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা-নিপীড়নের কারণে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে; এমন আশঙ্কা জানিয়েছিল দেশটি। সেই ধারাবাহিকতায় মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রধানও বলেছেন, রোহিঙ্গা-নিপীড়নের কারণে আইএস-এর উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়নের কারণে চরমপন্থার উত্থান-সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরাও।

এ বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইসলামি চরমপন্থা দমনে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন তারা। আর তা এমন কঠোর প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে যে সেখানে সংবাদমাধ্যমকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

মিয়ানমারের কথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের অন্যতম সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সেখানে সাম্প্রতিক সেনা অভিযানে ঘরহারা হাজারো রোহিঙ্গা মুসলিম চরমপন্থার দিকে ঝুঁকতে পারে। এমন পরিস্থিতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।

জাতিসংঘ এরইমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ তোলা হয় দুই দফায়। এবারের সংঘর্ষে রাখাইন রাজ্যের মৃতের সংখ্যা ৮৬ জন বলে জানিয়েছে তারা। জাতিসংঘের হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত ঘরহারা হয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ। পালাতে গিয়েও গুলি খেয়ে মরতে হচ্ছে তাদের। ২০১২ সালে মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের তাণ্ডবে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হন। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন ১ লাখেরও বেশি মানুষ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের সমালোচনা করে মার্কিন সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এতে দেশটিতে জিহাদি চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি রাখাইনের একাধিক পুলিশ চৌকিতে গত অক্টোবরে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। ওই এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলিমরা বসবাস করে। অভিযান শুরুর পর তাদের অনেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। রাখাইনে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আগে থেকেই উত্তেজনা রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-সংকট নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আহ্বান জানাতে প্রতিবেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড্যানিয়েল রাসেল। তিনি বলেন, এসব দেশের আহ্বানের জেরে ধর্মীয় উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। রাখাইনের পরিস্থিতি ঠিকমতো সামাল দিতে না পারলে জিহাদিরা সুযোগ নিতে পারে বলে সতর্ক করেন রাসেল। প্রতিবেশী বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে ওই চরমপন্থীরা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাসেলের মতো করেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মালয়েশিয়ার সেনাপ্রধান বলেছেন, এ সংকট ভালোভাবে মোকাবেলা না করা গেলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে যা আইএস-কে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তৃত করার সুযোগ দেবে। চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং লিয়াং এর সঙ্গে সাক্ষাতের পর মালয়েশিয়ার সেনাপ্রধান জুলকিফেলি মোহাম্মদ জিন এ সতর্কতা দেন। মালয়েশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতির বরাত দিয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টুডে খবরটি নিশ্চিত করেছে।

টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার (৭ ডিসেম্বর) মালয়েশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী বিবৃতিটি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জেনারেল জুলকিফেলি জেনারেল মিং অং লিয়াং-কে বলেছেন যদি এ সমস্যাকে ভালোভাবে এবং বুদ্ধিদীপ্তভাবে সামলানো না যায়, তবে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে যা আইএসকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তৃত করার সুযোগ দেবে। এদিন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন কিয়াও-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও একই সতর্কতা দেন জুলকিফেলি।’

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন একই কথা। তারাও রোহিঙ্গা দমনের ফলাফল হিসেবে জঙ্গিবাদ বিস্তৃতির আশঙ্কা করছেন। সিঙ্গাপুরভিত্তিক দু’জন জঙ্গিবাদ-বিশেষজ্ঞ জেসমিন্দার সিং এবং মো. হাফিজ জনি। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর যে ধরনের দমনপীড়ন চলছে, তা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় চরমপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কাকেই জোরালো করে তুলছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইট টাইমস-এ যৌথভাবে লেখা এক মন্তব্য-প্রতিবেদনে এই আশঙ্কার কথা জানান তারা। ওই মন্তব্য-ভাষ্যে তারা বলেন, ‘সেখানকার সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সংখ্যাগুরু বৌদ্ সম্প্রদায়োর। বিপরীতে রোহিঙ।গারা হলেন মুসলমান। এই বাস্তবতা [আরাকান রাজ্যের ঘটনায়] ধর্মীয় উপাদানের সংযোগ ঘটিয়েছে। সে কারণে মিয়ানমারে যা ঘটছে তাকে কেবল মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিসর থেকে আমলে নিলে চলছে না। ভাবতে হচ্ছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জঙ্গিবাদ ও সশস্ত্র ইসলামপন্থীদের নিয়েও।’

জেসমিন্দার সিং এবং মো. হাফিজ আশঙ্কা করছেন, প্রান্তিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মনের মধ্যে আশা রয়েছে যে কোনও মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠীই তাদের মুক্ত করতে পারে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ আর নিরঙ্কুশ সেনা-ক্ষমতার হাত থেকে। তারা জানাচ্ছেন, ইন্দোনেশিয়ার জিহাদি ওয়েবসাইটগুলো এরইমধ্যে রোহিঙ্গা নিপীঢ়নের ছবি, ভিও ও নানান ধারার প্রচারণা দিয়ে আপডেট করা হয়েছে। সেখানে ইন্দোনেশিয়া থেকে মিয়ানমারে প্রবেশের একটি মানচিত্রও দেওয়া রয়েছে।

অনলাইনে থাকা বেশ কিছু ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক এরইমধ্যে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিরপীড়নের প্রতিবাদে তারা এমনকী আত্মঘাতী হওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছে। মন্তব্য প্রতিবেদনে জেসমিন্দার সিং এবং মো. হাফিজ বলেন, রোহিঙ্গা সংকট জিহাদকে অনুপ্রাণিত করছে এবং জাকার্তার গভর্নরের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠার পর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি কঠির প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ঘোষণা দিয়েছে যে তারা রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী হওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’ জাসমিন্দার ও মোহাম্মদ হাজিক মনে করছেন, ইন্দোনেশিয়ানদের মতো রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মালয়েশীয়রাও মর্মাহত এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সংশ্লিষ্টতা একটি কঠিন বার্তা দিচ্ছে। তারা বলেছেন, ‘মুসলিম উগ্রপন্থীরা এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে এবং তাদের জঙ্গি লড়াইয়ের অংশ হিসেবে একে ব্যবহার করতে পারে।’ তারা আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মালয়েশীয়রাও প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। পুচং গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত মালয়েশীয় আইএস যোদ্ধা মোহাম্মদ ওয়ানদি তার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন তারা যে কাগুজে যোদ্ধা না তা যেন প্রমাণ করে। মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধ অথবা মিয়ানমারের নাগরিক পেলে তারা যেন হত্যা করে।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top