সকল মেনু

স্বপ্ন ছিল বড় ডাক্তার : হইলাম কুলি

 unnamedএম. শরীফ হোসাইন, ভোলা:  ভোলার তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে মামুন (৯) বয়সের একটি শিশু। বয়স বেশী হলে নয় কিংবা দশ। নাম তার মামুন। ছেলে বেলায় বাবাকে হারিয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন মতে টেনে হেঁচড়ে পড়াশুনা চালিয়েছে। চতুর্থ শ্রেণীতে উঠার পর পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়া হয়। কেননা পড়াশুনা করতে যে টাকার প্রয়োজন। মামুন যে বয়সটা পার করছে এই সময়টা হচ্ছে উঠতি বয়স। এই সময়ে তার করার দরকার ছিল বই হাতে স্কুলের উদ্দেশ্য রওনা দেয়া, কিন্তু সে বই না বরং মানুষের ব্যাগ হাতে নিয়ে রওনা হচ্ছে অজানা এক উদ্দেশ্য। এক বেলা যদি ভাত খায় তাহলে পরের বেলা চিড়া-মুড়ি দিয়ে দিন চালিয়ে দেয়।
মামুন যখন খুব ছোট তখন তার বাবা রোগে ভূগে মারা যায়। তারপর থেকে অভাব যেন পিছু ছাড়ছেনা মামুনের পরিবারের। দুই ভাই আর তিন বোনের মধ্যে মামুন ছোট। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও শশুর বাড়ীর কলহের কারণে এক বোন থাকে তাদের বাড়িতেই। অপরদিকে তার বড় ভাইর নাম মাসুম। পেশায় জেলে হলেও সে বেশির ভাগ সময়ই কাঁটে তীরে।
ভাড়া নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যায়। বেশ কিছু টাকা দেনা আছে তার, তাই মহাজন নৌকা দেয় না এখন। দিন খুঁজে দিন সংসার চলে মামুনের। অভাবের তাড়নায় পরে মামুন বেছে নিয়েছে কুলির কাজ। সারাদিনে ব্যাগ টেনে যা আয় হয় তা সম্পূর্ণই দেয় তার সংসারে। এই অল্প বয়সে মাথায় নিয়ে নিয়েছে এ গুরু দায়িত্ব। যেদিন কোন আয় না হয়, সেদিন লঞ্চঘাটের সকল যাত্রী ও দোকান থেকে ভিক্ষা করে টাকা উঠায়।
নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, অল্প বয়সে একটি বাচ্চা ছেলে প্রথমে একটি হোটেলে কাজ করছে। তারপর সে সেখানের কাজ শেষ করে আবার ভিক্ষা করতে নেমে যায়। তার সাথে আলাপ করলে,প্রথমত একটু ভীত হয়ে যায়, পরবর্তীতে বন্ধুসুলভ আচরণ করায় সে একটু সাধারণ হয় এবং বলে তার সমস্যাগুলো।
মামুন বলে, স্যার আমার আব্বা যখন মারা যায় তখন আমি অনেক ছোট। অভাব কী বুঝতাম না। আব্বা রোগে ভূগে মারা যায়। টাকার জন্য ভাল চিকিৎসা করাইতে পারে নাই, তখন স্বপ্ন ছিল একজন মেলা বড় ডাক্তার হমু, ডাক্তার হইয়া ফ্রীতে সবার চিকিৎসা করামু, যাতে কেউ ভাল চিকিৎসার লইগ্যা মারা না যায়। কিন্তু পরক্ষণে হইল উল্টো। স্বপ্ন ছিল বড় ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু ভাগ্যে দোষে হইলাম কুলি। দিনের টাকা যদি দিনে না কামাই করি ঘরের মানুষ যে না খাইয়্যা মরব। কুলিগিরি যদি নাই করতে পারি সেইদিন খুইজ্জা-খুইজ্জা খাই মানুষের থেকে। যেমন দেখেন না আজকে সবার থেকে খুইজ্জা খাইতেছি।
কথা হয় নাসরিন আক্তার (৪২) মামুনের মা তার সাথে। তিনি জানান, বাবা মামুনের আব্বা মারা গেছে আজকে মারা গেছে ১০ বছরের বেশি। টাকার অভাবে ভাল চিকিৎসা দিতে পারি নাই ওর বাপরে। বহু মানুষের পাও ধরছি, কিন্তু কেউ একটা টাকা দিয়া সাহায্যে করে নাই। তিনি মারা যাবার পর হইলাম নদী ভাঙ্গা, তারপর এই তেঁতুলিয়া নদীর তীরে কোনমতে ঘর তুইল্লা আছি। অভাবের মধ্যে আছি, ইচ্ছা ছিল পোলাপানগুলারে আর চার পাঁচটা পোলাপানের মত স্কুলে পড়ামু, মানুষ বানামু, কিন্তু এই সবই স্বপ্ন, গরীবের স্বপ্ন কোনদিন কী সত্যিই হয় বাবা! একটা সময় কম বেশি সবই ছিল, কিন্তু এই রাক্ষুসী তেঁতুলিয়া সব নিয়া গেছে। দুইটা গরু ছিল, বন্যায় হেগুলিও মইর‌্যা গেছে। আরো ছিল কিছু জমি। ওর বাপে মরার পরে দেনায় পইর‌্যা তখন শেষ সম্ভলটুকু বেইচ্চা ফালাই।
ভেদুরিয়া লঞ্চঘাট ও তেঁতুলিয়া নদীর পাড় ধরে হাটতে থাকলে মামুনের পরিবারের মত সহস্রাধিক পরিবারের দেখা মিলে। মাহফুজ, মিলন, ঝিলন এদের মত মামুনের বয়সী আরো অনেক শিশু-কিশোরেরা সবাই ছোট থাকতে হরেক রকমের স্বপ্নবুনে, কিন্তু বুঝের বয়স হলেই আর পারে না স্বপ্নগুলো বাস্তবে রুপ দিতে। কেননা তখন তাদের মাথায় অভাব নামক অভিশাপের বোঝা চেঁপে বসে। তাই তারা এই স্বপ্নগুলো মাথা থেকে ফেলে দিয়ে যে অবস্থায় যা পায় তা করেই জীবিকা নির্বাহ করে পরিবারকে সচ্ছল রাখতে। এই ছোট বয়সে মামুন ও মিলন’রা কোন সময় কুলির কাজ অথবা আবার কোন সময় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে টাকা অথবা খাবার খুজে বেড়ায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top