সকল মেনু

এখনো নিখোঁজ ১০

টঙ্গীতে অবস্থিত টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন সেনাসদস্যরা। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলোপুড়ে যাওয়া টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের সামনে বসে কাঁদছিলেন রুপালি আক্তার (৩০)। কোলে চার বছরের শিশুকন্যা সামিয়া। রুপালি এখনো তাঁর স্বামী কারখানার অপারেটর মাসুম আহমেদকে খুঁজে পাননি।
লক্ষ্মীপুরের আবু তাহের খোঁজ করছিলেন ছেলে রিয়াদ হোসেনকে।
টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় নিয়ন্ত্রণকক্ষের সামনে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালের দিকে তাঁদের মতো আরও কয়েকজনকে দেখা গেল নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে ফিরতে।
ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৩৪ জনের। আর নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন। গতকাল সকাল থেকে যথারীতি ধ্বংসস্তূপ অপসারণ ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন সেনাসদস্যরা। উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত একজনের বাবা গত সোমবার রাতে টঙ্গী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
গত শনিবার টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে যায়। এতে ঘটনাস্থলে ২৪ জন নিহত ও ৫০ জনের মতো আহত হন। ধসে পড়ে পাঁচতলা কারখানা ভবন ও পাশের দুটি তিনতলা ভবন। এই কারখানায় অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপার তৈরি হতো।
কারখানায় বিস্ফোরণের সঠিক কারণ এখনো নির্ণয় করা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মো. এ কে এম শাকিল নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু একটা বিস্ফোরণ থেকেই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে করতে পারে, আবার মেশিনের ত্রুটির কারণেও হতে পারে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষেই আমরা সঠিক কারণ জানতে পারব।’
সোমবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজ শুরু করেন। তাঁরা রাস্তার ওপর ভেঙে পড়া ছাদের একাংশ সরাতে শুরু করেন। বেলা দুইটার দিকে পরপর ২টি লাশ এবং রাত ১০টার দিকে চারটি লাশ উদ্ধার করেন তাঁরা। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আরও একজনের।
গতকাল সকালে কারখানার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে কর্মকর্তাদের ডাইনিং টেবিল, হাঁড়িপাতিল ও কিছু বই অক্ষত অবস্থায় বের করা হয়। দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করতে কারখানার সামনে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন দুটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করেছে।
ফায়ার সার্ভিস গত মঙ্গলবার আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে ফেলার ঘোষণা দেয়। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আনিস মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, কারখানায় এখন আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।
আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান গত সোমবার দুপুরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ঘটনাস্থলটি পূর্ব-পশ্চিমে আনুমানিক ৬০০ ফুট, উত্তর-দক্ষিণে ৩০০ ফুট। যার মধ্যে চারটি বড় ভবন রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
কারখানার সুপারভাইজার গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার দিন সকাল নয়টা থেকে তাঁর ডিউটি ছিল। ঈদের আগে ওই দিনই ছিল তাঁদের শেষ কর্মদিবস। এর আগে দুর্ঘটনা ঘটায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন।
সরেজমিন: গতকাল সকালে কারখানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের কয়েকজন স্বজনকে আহাজারি করতে দেখা যায়। টঙ্গীর হায়দরাবাদ করিম মার্কেট এলাকার বাসিন্দা রুপালি আক্তার (৩০) বলছিলেন, গত শুক্রবার রাতে স্বামী মাসুদ আহমেদের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। ওই সময় তিনি বলেছিলেন ‘তোমরা তৈরি হয়ে থেকো, আমি ডিউটি শেষ করে এসে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হব। তিনি আর ফিরেও আসলেন না, আমাদেরও আর বাড়ি যাওয়া হলো না।’
গতকালও ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা গেল। উৎকট দুর্গন্ধ থেকে কেউ কেউ ধারণা করলেন, ভেতরে হয়তো লাশ রয়ে গেছে।
মামলা: টঙ্গী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত জুয়েল মিয়ার বাবা আব্দুল কাদের গত সোমবার রাতে টঙ্গী থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় কারখানার মালিক সিলেট-৬ আসনের সাবেক সাংসদ সৈয়দ মকবুল হোসেন, তাঁর স্ত্রীসহ মোট আটজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
নিহত ব্যক্তিদের তালিকা: জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে টাঙ্গাইলের সুভাস চন্দ্র প্রসাদ (৩৫), ভোলার জাহাঙ্গীর আলম (৪০), ময়মনসিংহের রফিকুল ইসলাম (২৮), একই এলাকার আব্দুর রাশেদ (২৫), চাঁদপুরের আব্দুল হান্নান (৬৫), কুড়িগ্রামের ইদ্রিস আলী (৪০), ঢাকার নবাবগঞ্জের গোপাল দাস (২৫), একই এলাকার শঙ্কর কুমার (২৫), পিরোজপুরের আলম মামুন (৪০), সিলেটের এনামুল হক (৩৮), কিশোরগঞ্জের মো. সোলেমান (৩৫), টাঙ্গাইলের আনিসুর রহমান (৫০), একই এলাকার ওয়ালি হোসেন (৩৫), ভোলার মাইনুদ্দিন (৩৫), সিলেটের
সাইদুর রহমান (৫০), টাঙ্গাইলের হাসান সিদ্দিকী (৫০), চট্টগ্রামের মামুন (৪০), সিলেটের মিজানুর রহমান (২৫), হবিগঞ্জের রোজিনা আক্তার (২০), তাঁর ছোট বোন তাহমিনা আক্তার (১৮), টঙ্গী আমতলী এলাকার রাজেশ বাবু (২৫), বাগেরহাটের রিপন দাস (৩০), শরীয়তপুরের আনোয়ার হোসেন (৪০), সিরাজগঞ্জের ওয়াহিদজ্জামান তপন (৩৬), শেরপুরের দেলোয়ার হোসেন (৫০), মো. জুয়েল মিয়া (৩০), ময়মনসিংহের আশিক মিয়ার (১৪) নাম জানা গেছে। নিহত অন্যদের নাম-পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।
যাঁরা নিখোঁজ: নিয়ন্ত্রণকক্ষে গতকাল পর্যন্ত ১০ জন নিখোঁজ শ্রমিকের নামের তালিকা জমা পড়েছে। তাঁরা হলেন সিলেটের রেদওয়ান আহমেদ (৩৬), টাঙ্গাইলের জহিরুল ইসলাম (৩৭), লক্ষ্মীপুরের রিয়াদ হোসেন মুরাদ (৩২), সিরাজগঞ্জের আনিছুর রহমান (৩০), কিশোরগঞ্জের রফিকুল ইসলাম (৪০), চাঁদপুরের নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (৪৫) ও কুমিল্লার মাসুম আহমেদ (৩০) ও ফরিদপুরের চুন্নু মোল্লা (২১), কুমিল্লার মাসুম আহমেদ (৩০) ও সিলেটের জয়নুল ইসলাম (৩৫)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top