এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা: ১৭ জন মাঝি-মাল্লা নিয়ে সাগরে ট্রলার ডুবির ১৩ ঘন্টা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে জীবিত ফিরে এসেছি’ ভাগ্যক্রমে কেউ মারা যায়নি, সেই ঝড়ের কথা মনে পড়লে আজো গা শিউরে উঠে। ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কথা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ভোলার চরফ্যাশনের জেলে আবদুল মান্নান।তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের দিন ঢালচরে অদুরে সাগর মোহনায় মাছ শিকার করছিলেন তিনি, এ সময় হঠাৎ করেই প্রচন্ড বাতাসে ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলার ভেঙ্গে ডুবে যায়, শুধু ট্রলার নয়’ ওই ঝড়ে তার বসত ঘরটাও বিধ্বস্ত হয়, কিন্তু কোন সহযোগীতা পাননি’।বাঁধের বাসিন্দা বিবি আমেনা বলেন, মহাসেনে তার ক্ষতির পরিমান অনেক, ২০টি ছাগল ও একটি গরু মারা যায়, ভেঙ্গে যায় মাথা গোজাই ঠাই টুকুও। সেই ঝড়ের কথা মনে হলো এখনও ভয় করে’।মান্নান মাঝি ও আমেনাদের মত হাজারো পরিবার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাননি কোন সহযোগীতা। সেই প্রলংকারী ঝড়ের স্মৃতি মনে করে আজো কাঁদেন তারা।
৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো ভোলার উপকূলে পড়ে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের ক্ষতচিহ্ন। ঘরভীটা, জমি, পুকুর ঘের ও গৃহপালিত পশু হারিয়ে আজো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্তরা। সরকারিভাবে এদের ভাগ্যে জুটেনি কোন সাহায্য সহযেগীতা। সেই ঝড়ের কথা মনে করে আজো আঁতকে উঠেন উপকূলের মানুষ। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক ব্যবস্থা নেয়ায় ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়েছে। সুত্র জানায়, ‘ঘুর্ণিঝড় মাহাসেন’ মোকাবেলায় প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতিতে ভোলায় প্রাণহানি তেমন না ঘটলেও জেলা সদর, মনপুরা ও চরপ্যাশনে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩০ হাজার ঘরবাড়ি। মুহুর্তের মধ্যেই ওই ঝড় লন্ড-ভন্ড করে ধ্বংসলীলায় পরিণত করে উপকূলের জনপদ। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে অনেকেই আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। অর্থের অভাবে ভাঙ্গা ঘর মেরামত করতে পারেননি তারা। উপকূলে যেন এখন পড়ে রয়েছে মহাসেনের সেই ক্ষত চিহ্ন।
সরকারীভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের বরাদ্দ দেয়া হলেও অনেকের কাছে তা পৌছায়নি বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। চরফ্যাশনের বেতুয়া বাঁধ এলাকার বাসিন্দা আবু তাহেরের স্ত্রী নুর নাহার বলেন, স্বামী মারা গেছে কয়েক বছর আগে’ একটি ব্রিক ফিল্ডে কাজ করে ২ মেয়েকে বসবাস করছি’ মহাসেনে একটি গরু ও বসত ঘর বিধ্বস্ত হয়। ভাঙ্গা ঘরটি মেরামত করতে পারিনি, এখন পরে সেই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আরেক পরিবারের আয়েশা বলেন, ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ে নিয়ে আমাদের পরিবার, ছবি তুলে লাভ নেই আমাদের ভাগ্যে কোন সাহায্য জুটেনা। রিলিফ জুড়ে বড় আলাদের ভাগ্যে। ঝড়ে ২টি গরু ও ২টি ছাগল মারা গেলে এখন কোন সাহায্য পাইনি।
মনপুরার আকলিমা, ছিদ্দিক ও শাহে আলম বলেন, মহাসেন শুধু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করেনি, উপকূলের মানুষের আয়ের উৎস ধ্বংস করেছে। আপ্রাণ চেস্টা করেও ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেনা।ভোলা সদরের তুলাতলী বাঁধ এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ওই ঝড়ে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেছে, ফসলের ক্ষেত, পুকুর। কিন্তু সরকারী সাহায্য ছিলো খুবই কম। যারফলে এক বছরেও ওই ক্ষতি পুশিয়ে উঠতে পারিনি।
এদিকে উপকূলবাসীর অভিযোগ উপকূলের একের পর এক ঝড় আঘাত হানলেও দুর্যোগ মোকাবেলায় তেমন প্রস্তুতি নেই জেলা প্রশাসনের। নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার ও মাটির কিল্লা। জেলা-উপজেলা প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করলেও দুর্যোগকালীয় সময়ে এখনও উপকূলের মানুষ অনিরাপদ থাকছেন।
এ ব্যাপারে ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, ঝড়ের পরবর্তি সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরী করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনেও।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১৬ মে’র ঘুর্ণিঝড় মহাসেনে ভোলার ৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ফসলি জমি, পুকুর, মাছের ঘের, গবাদী পশু হারিয়ে বার বারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষ। প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাধ বিধ্বস্ত হয়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।