সকল মেনু

মৃত্যুপুরী রাজশাহী!

৩নিজস্ব প্রতিবেদক, হটনিউজ২৪বিডি.কম ২৫ এপ্রিল : রাজশাহী এখন যেন এক মৃত্যুপুরী! এই শহরে কারো জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পথে খুন হচ্ছেন শিক্ষক। হোটেল কক্ষে মিলছে শিক্ষার্থীদের লাশ। নিজের অফিসে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। এই পরিস্থিতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেছেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তাতে যে কোন সময় দেখা যাবে রাস্তায় আমার লাশ পড়ে আছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে শহরে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না, আওয়ামী লীগ নেতারাও জীবন নিয়ে শঙ্কায় যে শহরে, সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা কোথায়?

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডানপন্থী ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী এই শহরে গেঁড়ে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে শক্ত ঘাঁটি শিবিরের। ফলে প্রগতিশীল শিক্ষক থেকে শুরু করে মুক্তমনা মানুষদের চলাফেরাই এখন দায়। একের পর এক খুন হচ্ছেন শিক্ষকরা। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের কোন্দলে খুন হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতারা। ফলে এই শহরটি এখন আর মুক্তচিন্তার মানুষদের জন্য নেই। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকও জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উত্তাল। ইংরেজী বিভাগের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশ শেষে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিনেট ভবনের সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে মৌন মিছিল ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করা হয়। মিছিল শেষে তারা পুনরায় সিনেট ভবনের সামনে এসে বিক্ষোভ সমাবেশে মিলিত হন। এসময় ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষর্থীরা অবরোধ কর্মসূচি শেষ করে শিক্ষক সমিতির মৌন মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিয়ে সংহতি প্রকাশ করে। শিক্ষক সমিতির সমাবেশ শেষে ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে লিখনী ও সমাবেশের মাধ্যমে দিনভর প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু এই হত্যাকান্ডে এক শিবির নেতাকে গ্রেফতার করা ছাড়া রোববার পর্যন্ত  তেমন কোন অগ্রগতি নেই।

সমাবেশে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যার ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এখন চরম সঙ্কটে। আমরা হত্যাকারীদের দেখতে পাচ্ছিনা, তাদের শাস্তিও হচ্ছেনা। কিন্তু নিহতের তালিকা বেড়েই চলেছে। যেন আমরা মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছি। এ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্কের সংস্কৃতি দেখতে পাচ্ছি। আমরা আতঙ্কের সংস্কৃতি নয়, আইনের শাসন দেখতে চাই।’

এদিকে রোববার বিকালে রহস্যজনক গুলিতে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রশাসক এবং জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জিয়াউল হক টুকু নিহত হয়েছেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নগর ভবনের সামনে নিজের ব্যবসায়িক চেম্বারে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাকে দ্রুত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এবং নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন খান জানান, ‘প্রথমে শুনেছিলাম টুকু নিজের পিস্তলের গুলিতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু রাত সোয়া ৮টার দিকে খবর পেলাম এক ব্যক্তি তাকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে। সে নিজেই হত্যার দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করবে বলে জানিয়েছে। তবে এই মৃত্যুর বিষয়টি এখনো রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি।’

এর আগে রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া এলাকা থেকে গত ১ এপ্রিল রাসেল হোসেন (৩৫) নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাসেলের স্ত্রীর আগের স্বামীর পক্ষের ছেলে রবিনকে আটক করেছে পুলিশ। ১৭ এপ্রিল মহানগরীর শাহ্ মখদুম থানাধীন বায়ার ভাড়ালীপাড়া এলাকায় স্ত্রীকে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা করেন স্বামী আয়নাল হক। এ ঘটনার পর ঘাতক আয়নাল ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলের পাশেই বসে ছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেন। এরকম অস্বাভাবিক সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে রাজশাহী শহরে।

গত ২২ এপ্রিল নগরীর অভিজাত আবাসিক হোটেল নাইস ইন্টান্যাশনালের একটি কক্ষ থেকে পুলিশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান এবং পাবনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করে। এই হত্যাকান্ড নিয়ে এখনো অন্ধকারে পুলিশ। তারা বলছে, নাসরিনকে হত্যার পর মিজানুর আত্মহত্যা করতে পারে। তবে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলছেন, দুইজনকেই হত্যার আলামত মিলছে। তবে বিষয়টি পরিষ্কার হতে একটু সময় লাগবে।

এর পরদিন গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা অধ্যাপক এএফএফ রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুবৃর্ত্তরা। এ ঘটনায় পুলিশ হাফিজুর রহমান নামের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে। সে নগরীর ১৯ নং ওয়ার্ড ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি বলে জানা গেছে। তার সম্পৃক্তার বিষয়টি এখনো পরিষ্কার করেনি পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, উগ্রবাদী গোষ্ঠীই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এনামুল হক বলেন, আঘাতের ধরন দেখে মনে হয়েছে, এটা কোনো প্রশিক্ষিত চরমপন্থি গ্রুপের কাজ। ব্লগার হত্যার ধরনের সঙ্গে এই হত্যাকান্ডের মিল রয়েছে। ধারালো অস্ত্রের একটি আঘাতেই অধ্যাপকের মাথা শরীর থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেছে। মাত্র দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি চামড়া ও রগের সঙ্গে মাথাটি শরীরের সঙ্গে লেগে ছিলো। আরেক শিক্ষক শফিউল ইসলাম লিলন হত্যাকান্ডের সঙ্গেও এই হত্যার মিল রয়েছে। প্রশিক্ষিত খুনি ছাড়া এটি সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১২ বছরে হত্যাকান্ডের শিকার চারজন শিক্ষকের মধ্যে তিনজনকেই প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর একজনকে নিজ বাসায় হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের সঙ্গে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সংশ্লিষ্টতা আসলেও প্রকাশ্যে হত্যাকান্ডের শিকার দুইজন শিক্ষকের প্রকৃত খুনিরা সনাক্ত হয়নি বলে স্বজন ও সহকর্মীরা অভিযোগ করে আসছেন। এ কারণে রাবির শিক্ষক হত্যা বন্ধ হচ্ছে না বলে অনেকে মনে করছেন।

হত্যার বিচার দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন : গত রোব দুপুর ১টার দিকে শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যার বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন রাবির ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ধারালো অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় ও বহনের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা ও হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা বন্ধসহ নানা দাবি জানানো হয়।

এছাড়া আজ সোমবার রাবিসহ রাজশাহীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন, সকাল ১১টায় নগরীর আলুপট্টি থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত মুখে কালো কাপড় বেধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ, বিভাগে শোকসভা ও আগামী তিনদিন বিভাগের ক্লাশ-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top