সকল মেনু

ট্রাক্টরের বেপরোয়া চলাচলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে চাঁদপুরের সড়কগুলো

indexশাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য দেশে ট্রাক্টর আনা হলেও সেই ট্রাক্টর কৃষি কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। ব্যবহার হচ্ছে গ্রামের ছোট সড়ক থেকে শুরু করে শহরের মহাসড়ক পর্যন্ত। সর্বত্র এর অবাধ বিচরণের কারণে সড়কের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি কোনো না কোনো দিন এর চাকায় পিষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে শুধু হাজীগঞ্জে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে এই দানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে। ট্রাক্টর চলাচলে কিছু বিধিবিধানের বিষয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় সিদ্ধান্ত হলেও তা মানা হচ্ছে না। সব দিক দিয়ে ক্ষতিকর এ যন্ত্র দানবটি কার বা কাদের স্বার্থে সড়কে চলাচল করছে এটা কারোরই বোধগম্য নয়।
জানা যায়, ভারতের বিভিন্ন কোম্পানী ট্রাক্টর তৈরি করলে তা এ দেশে আমদানি করা হয় কৃষি কাজের জন্যে। গরু দিয়ে হাল চাষের আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে ট্রাক্টরের চাষ। শুরুতে ট্রাক্টরের ইঞ্জিনের পেছনে একটি লাঙ্গলের সেট বসিয়ে এটিকে কৃষি কাজে লাগানো হতো। কিন্তু পরে এর রূপ পরিবর্তন করে এর ইঞ্জিনের পেছনে আলাদা একটি বডি সংযোজন করে তার নীচে দুটি করে চারটি চাকা বসিয়ে দিয়ে এটিকে মালামাল পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি এখন শহর-গ্রাম সর্বত্র কাঁচা-পাকা সড়কে অবাধে বীরদর্পে চলাচল করছে। আর এর মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সড়ক এবং কেড়ে নেয়া হচ্ছে মানুষের প্রাণ।

টাক্টর চালকদের কারো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ট্রাক্টর চালনার উপর কোনো ধরনের লাইসেন্স ইস্যু করে না। বেপরোয়া গতির কারণে প্রায় সময় ট্রাক্টর নিজে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, না হয় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ মারছে। বেপরোয়া গতি ও ট্রাক্টরের শরীরের মাঝখানের দুটি বড় চাকার কারণে সব ধরনের সড়কের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে।  কথিত রয়েছে, যারা ট্রাক্টর চালাচ্ছে বা ট্রাক্টরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ নেশাগ্রস্থ। সড়কে ট্রাক্টর চলাচল করা যাবে না এ জন্যে সরকারি আইন রয়েছে। আর সে আইনকে তোয়াক্কা না করে ট্রাক্টর সড়ক-মহাসড়ক দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে এবং মানুষও মেরে ফেলছে।
গেলো সপ্তাহেই হাজীগঞ্জে দুজনকে হত্যা করেছে মানব ঘাতক ট্রাক্টর। এর মধ্যে চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের বাকিলা বাজার এলাকার খলাপাড়া গ্রামের রবিউল (১৫) এবং হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়কের সেন্দ্র্র বাজার এলাকায় শিপন (১৭) কে হত্যা করে ট্রাক্টর। দুটি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বেপরোয়া চলাচল ও অনভিজ্ঞ চালক। এ ঘটনায় সেন্দ্রা এলাকার বিক্ষুব্ধ জনগণ ঘাতক ট্রাক্টরটিকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত শিপন আর রবিউলের ভাগ্য অনেকটাই এক। রবিউলের পরিবার নিতান্ত গরিব হওয়ার কারণে মামার বাড়ি বাকিলা ইউনিয়নের গোগরা হাওলাদার বাড়িতে থেকে ট্রাক্টরের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। যে ট্রাক্টরে শ্রমিক হিসেবে রবিউল কাজ করতো সেই ট্রাক্টরের নিচে পড়েই সে মারা যায়। চালকের বেপরোয়া গতির কারণে চালকের পাশে বসা রবিউল চলন্ত অবস্থায় ওই  ট্রাক্টরের নিচে পড়ে গিয়ে আহত হয়। আহত হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রবিউল মারা যায়। অপরদিকে বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান সেন্দ্রায় নিহত শিপনের বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। পড়ালেখার পাশাপাশি সে বিদ্যুতের কাজ করে সংসার চালাতো। এখানেও দ্রুতগামী ট্রাক্টর শিপনকে চাপা দিয়ে সাথে সাথে মেরে ফেলে।
খোদ চাঁদপুর শহরের রাস্তাগুলোতেই দেদারছে ট্রাক্টর চলাচল করছে। ইট, বারু, রড, সিমেন্ট , কাঁচা মাল পরিবহনে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। মাঝে মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও তা আটকে রাখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতাদের চাপে ও প্রভাবশালীদের প্রভাবে এগুলো ছাড়া পেয়ে যায় সহজেই। ট্রক্টর থেকে উড়ন্ত বালু বাতাসের সাথে উড়ে পথচারীদের চোখে মুখে পড়ছে। অনেকের চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একারণে। তাছাড়া যারা শ্বাস কষ্ট জনিত রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষতি হচ্ছে বেশি।
হাজীগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি অফিস সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, গ্রামীণ অবকাঠামোয় নির্মিত সড়ক নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ট্রাক্টর চলাচল। উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, যে সড়কগুলো দিয়ে ট্রাক্টর চলাচল করে সেগুলো নির্মাণের ৬ মাসের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। আর সাধারণত যে সড়কগুলো দিয়ে ট্রাক্টর চলাচল একেবারে কম, সেই সড়কগুলো ৩/৪ বছরে তেমন একটা নষ্ট হয় না।
হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার বলাখাল জেএন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, বলাখাল এলাকার ডাকাতিয়ার পাড়ে বেশ কয়েকটি বালুর ঢিবি রয়েছে। প্রতিদিন এই ঢিবি থেকে প্রায় অর্ধশত ট্রাক্টর বালু আনা নেয়ার কাজ করে। বেপরোয়া চলাচলের পাশাপাশি এর চালক ও হেলপাররা সড়কের পাশ দিয়ে যেতে থাকা ছাত্রীদের ইভটিজিং করে থাকে। এটা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লালমাই গ্রুপের সিনিয়র মার্কেটিং কর্মকর্তা হিসেবে চাঁদপুরে কাজ করছেন এমন একজন মোঃ হাবিবুর রহমানকে কাজের কারণে দিনের অধিকাংশ সময় মোটর সাইকেলে রাস্তায় থাকতে হয়। এ বিষয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, বিশেষ করে চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ সড়কে ট্রাক্টরগুলো একেবারে নিয়মনীতির বাইরে চলাচল করে। ট্রাক্টরের পেছনে কয়েক মিনিট অন্য গাড়ি চালালে ট্রাক্টরের উড়ন্ত বালুতে চোখ আর মুখের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আর এর কোনো হর্ন নেই, শব্দ শুনে বুঝতে হয় ট্রাক্টর আসছে। সবচে’ ভয়ঙ্কর হলো রাতের বেলা। ট্রাক্টরের সামনে একটি লাইট থাকে, অনেক সময় বুঝার উপায় থাকে না এটি ট্রাক্টর না মোটর সাইকেল।
এ বিষয়ে  অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে এবং প্রতিদিন মামলা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরে ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে অভিযান শুরু হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top