আব্দুল ওয়াহাব মুকুল: যশোরের শার্শার সামটা গ্রামের মানুষ এক দশক ধরে ভুগছে আর্সেনিক বিষের ব্যাধিতে। আজও পরিবর্তন হয়েনি ঐ গ্রামের ১৫০টি পরিবারের। যশোর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গ্রামটি তে প্রায় ৯০ শতাংশ সদস্য আর্সেনিকে আক্রান্ত। সরকারিভাবে গভীর নলকূপ বসানোর পর আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা হলেও আগে আক্রান্তদের চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে।সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, যশোরে এসে তাদের চিকিৎসা নিতে হয়। এরইমধ্যে আক্রান্ত অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের টেকনিক্যাল সুপারভাইজার রহুল কুদ্দুস বলেন, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তারা ওই গ্রামে সচেতনতা বৃদ্ধি, আর্সেনিকমুক্ত পানি ও রোগীদের ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে। তখন ওই গ্রামে রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৬৩ জন। ওই গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে লিভার ক্যান্সার, কিডনি বিকল, ফুসফুসের ক্ষত, শরীরের বিভিন্ন ধরনের ঘা, ত্মকের ক্যান্সারে আক্রান্ত ১৭ জনের এখনও চিকিৎসা দিচ্ছে তারা। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে সামটা গ্রামে আর্সেনিক বিষয়ক তাদের অন্য সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি।
চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সময় ওই গ্রামে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে ওই সংস্থার কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজার মঞ্জুয়ারা পারভীন বলেন, ওই গ্রাম থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও যশোর অফিসে মাসে একবার আর্সেনিকোসিসে মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ‘নিপসমের’ একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেন। রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসা খরচের শতকরা ১০ ভাগ নেওয়া হয় বলে জানান মঞ্জুয়ারা। শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর মোরশেদ সামটা গ্রামে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত কয়েকজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে বলেন, ওই গ্রামে কয়েক বছর ধরে সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। আপাতত ওই সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সামটা গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য আকবর আলি বলেন, সামটা গ্রামের কারিগর পাড়াতেই কেবল আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। ওখানে ১৫০টি পরিবার বসবাস করেন। প্রতিটি পরিবারের ৯৫ ভাগ লোকই আর্সেনিকে আক্রান্ত।
এক সময় আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের অভাব ছিল, তবে সরকারিভাবে গভীর নলকুপ বসানোর পর তা দূর হয়েছে। তবে সরকারিভাবে এখন তাদের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারিভাবে তাদের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। এই কারিগর পাড়ায় আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে গত দশ বছরে অন্তত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গতবছর মারা যান রেঞ্জুয়ারা, আব্দুল গনি, রহুল কুদ্দুস, রৌফা বেগম, মুনসুর আলি ও রফিকুল ইসলাম। এখনও আক্রান্তের সংখ্যা ৫শ ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি করেন আকবর আলি। দশ বছর ধরে আর্সেনিকোসিসে ভুগে এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছেন ওই পাড়ার শুকজান বিবি (৪৫)। এই রোগে তিনি হারিয়েছেন স্বামী শওকত আলি, শ্বশুর দাউদ আলি, শাশুড়ি মেহেরন নেছা ও খোদেজা বেগমকে। শুকজান বলেন, আমাদের ফটো তুলে আর কী করবা-? তোমাদের মতো কতো লোক আসে আর ফটো তুলে নিয়ে যায়। আমাদের তো কোনো লাভ হয় না। আমরা ‘বাঁচতি’ চাই। আমাদের ওষুদের (ঔষধ) ব্যবস্থা ‘করতি’ পার যদি তবে ফটো তোলো।
শুকজান বিবির মতো স্বামী সন্তান হারিয়েছেন জরিনা বেগম, রিজিয়া বেগম, রশিমন বিবি, হামেদা খাতুন, বানু বিবি, শহিতন নেছা, হামে, রশিমন বিবি, কুলছুম ও শাফিয়ারার মতো ২৩ জন নারী। ওদের পাশাপাশি মোহর আলি, বজলুর রহমান, রেজাউল ইসলাম, দমশের আলি, খলিলুর রহমান ও শাহাজানের অবস্থাও সংকটাপন্ন। এরা সবাই আর্সেনিকের প্রভাবে লিভার ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্ষত, চামড়ায় বিভিন্ন ধরনের ঘা নিয়ে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছেন দিন দিন। বানু ও শহিতন বলেন, তাদের পরিবারের ১৩ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এখন তারাও আক্রান্ত। আগে এক সময় এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক ওষুধ দিত। বছর দুই হলো আর কেউ ওষুধ দেয় না, খোঁজ-খবরও নেয় না বলে জানান তারা। আর্সেনিকের বিষে কিডনি আক্রান্ত হয়েছে বজলুর রহমানের। তিনি বলেন, প্রথম প্রথম মনে করতাম এসব জিন-ভূতের কাজ। পরে সরকার ও জাপানিরা টিউবওয়েলের পানি, আমাদের চুল, নখ, চামড়া পরীক্ষা করে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তের কথা জানায়। অনেক গ্রামবাসীর মৃত্যুর পর ‘বুঝতি’ পারছি। সহায় সম্বল বেচে চিকিৎসা নিতি যেয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে পড়িছি। আমরা ‘বাঁচতি’ চাই।”সরকার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে না এলে তাদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।