হেগ, ৫ নভেম্বর ২০১৫, নিরাপদনিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস জনগণের জন্য বদ্বীপকে নিরাপদ ও উৎপাদনশীল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান (বদ্বীপ পরিকল্পনা) ২১০০ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ জোরদার করতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে একমত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের মধ্যে বুধবার রাতে ডাচ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ক্যাটসুইস’ এ অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে এক যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, কৃষি, বন্দর উন্নয়ন এবং আইনের শাসনসহ পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দ্বিপাক্ষিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এরপর মার্ক রুটের আয়োজনে অনুষ্ঠিত নৈশভোজে পানি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রী ডেল্টা কোয়ালিশন কাঠামো কর্মসূচির মধ্যে সারা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলগুলোকে নিরাপদ ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করতে একসাথে কাজ করতে একমত হয়েছেন ।
এক্ষেত্রে দুই নেতার অভিন্ন অভিমত হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস উভয় দেশই হচ্ছে বদ্বীপ প্রকৃতির এবং বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
দুই প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে জুনে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের লক্ষ্যে সহিষ্ণু ও টেকসই বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং ভূমি সংযোজন ও পুনরুদ্ধার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ক একটি আগ্রহপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বদ্বীপ ব্যবস্থাপনায় নেদারল্যান্ডের দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্লান) ২১০০ প্রণয়নে সহযোগিতার জন্য ডাচ প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদী সামর্থ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এর অধীনে নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে একটি কার্যকর অংশীদারিত্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডাচ প্রধানমন্ত্রী ডেল্টাকে নিরাপদ ও জনগণের জন্য সুফলদায়ক করতে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
দুই প্রধানমন্ত্রী সন্তোষের সঙ্গে উল্লেখ করেন যে, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস এক সুদৃঢ় ও পারস্পরিক লাভজনক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। দু’দেশের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এই সম্পর্ক আরো জোরদারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
উভয় পক্ষ সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রী পর্যায়ে সফরে সন্তোষ প্রকাশ করে উচ্চ পর্যায়ে সফর বিনিময় আলোচনা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করেন। দুই প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে এ ধরনের সফর বিনিময়ের ভূমিকার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন।
২০১৫ সালে ১০ সেপ্টেম্বর হেগ নগরীতে প্রথমবারের মতো দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ায় উভয় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন।
উভয় প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন যে, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের এক মুখ্য অনুঘটক। তারা সন্তোষের সঙ্গে উল্লেখ করেন যে, নেদারল্যান্ডস হচ্ছে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির অন্যতম গন্তব্য ও বাংলাদেশের জন্য এফডিআই লাভের শীর্ষ উৎস দেশ। উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাচ প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছেন যে, বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, পানি ও সমুদ্র খাতে অবকাঠামো, আইটি ও পর্যটনসহ ওষুধ, চামড়া, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ, হালক প্রকৌশল, পাট, জাহাজ তৈরি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর মতো উদীয়মান খাতে বিনিয়োগ করতে ডাচ বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানান।
ডাচ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে অংশগ্রহণের এ আগ্রহের উল্লেখ করে ডাচ পক্ষকে এ প্রকল্প প্রস্তাবনায় তাঁর সরকারের যথাযথ বিবেচনার আশ্বাস দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাচ প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন যে, তাঁর সরকার তৈরি পোশাক খাতকে টেকসই শিল্পায়নের মডেলে পরিণত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছে।
এ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে অর্থায়ন সুবিধা লাভ এবং ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়গুলোর সমাধানে নেদারল্যান্ডের সহায়তা কামনা করেন।
নেদারল্যান্ড একটি টেকসই তৈরী পোষাক খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রশংসা করে এ খাতে একটি প্রধান ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ দিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তাদের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে।
দুই প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছেন।
উভয় পক্ষ শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় সংস্থার অবদান স্বীকার করেছে।
ডাচ প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অপারেশনে (ইউএনপিকেও) সর্বোচ্চসংখ্যক সেনা ও পুলিশ পাঠিয়ে অবদান রাখায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন এবং ২০১৭-১৮ সালের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নেদারল্যান্ডের অস্থায়ী আসনের জন্য সমর্থন দেয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান।
দুই প্রধানমন্ত্রী মানবিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের ধারণা নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (ইউএনজিএ) গৃহীত ‘২০৩০ এজেন্ডা ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ স্বাগত জানিয়েছেন। তারা এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
এমডিজি’র লক্ষ্যসমূহ অর্জনের সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করে ডাচ প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এসডিজি বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বে নেতৃত্ব দিবে।
ডাচ প্রধানমন্ত্রী ‘গ্লোবাল ফান্ড ফর মাইগ্রেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফর ২০১৬’-এর সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানান। দুই প্রধানমন্ত্রী মানব জাতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন।
চলতি বছর প্যারিসে জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (কোপ-২১) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সকল পক্ষের জন্য স্বচ্ছ ও প্রযোজ্য নতুন আন্তর্জাতিক কার্যকর ফ্রেমওয়ার্ক বিষয় আইনী বাধ্যবাধকতার চুক্তিকে উপনীত হতে দুই দেশ সক্রিয় অবদান রাখবে। বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও অভিযোজনের জন্য এই ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে।
দুই প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোকে স্বাগত জানান।
চুক্তিগুলো হলো- ১. নেদারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পররাষ্ট্র দফতর পর্যায়ে আলোচনা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক;
২. বাংলাদেশ থেকে জুনিয়র কূটনীতিকদের জন্য প্রশিক্ষণ সহযোগিতা বিষয়ে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) স্বাক্ষর;
৩. স্যাক্সন ইউনিভার্সিটি অব এ্যাপ্লাইড সায়েন্স, স্কুল অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি এবং বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজির মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর; এবং
৪. স্যাক্সন ইউনিভার্সিটি অব এ্যাপ্লাইড সায়েন্স এবং বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি’র মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তি/সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরস্পরের সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের জন্য ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটকে আমন্ত্রণ জানান। ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে ছিলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুন, নৌপরিবহন সচিব শফিক আলম মেহেদী, পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং নেদারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলাল।-বাসস
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।