সকল মেনু

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জলের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে

1436035911

নিজস্ব প্রতিবেদক- বরিশাল, হটনিউজ২৪বিডি .কম ০৫ জুলাই : সারা বছর ভালো গেলেও বর্ষাকাল এলেই উৎকণ্ঠা বাড়ে উপকূলের কোটি মানুষের। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে প্রতি বছর এ অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। ভূমিহীন এ পরিবারগুলো বেড়ি বাঁধের উপর আশ্রয় নিচ্ছে। জীবন-জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে রাজধানী ঢাকা কিংবা দেশের বড় শহরগুলোতে। উপকূলে বেঁচে থাকা মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে জীবন যুদ্ধে সামিল হওয়া। নদী ভাঙ্গনের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা গেছে, গত ৪৪ বছরে এ অঞ্চলের ১৫টি নদীর কড়াল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক গ্রাম। গৃহহারা হয়েছে কয়েক লাখ পরিবার। খোদ নগর সংলগ্ন চরবাড়িয়া, চরমোনাই, চরকাউয়া, চরআইচা ও চরবদনা এলাকার শত শত পরিবার গৃহহীন হয়েছে কীর্তনখোলা নদীর ভাঙ্গনে। এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই কীর্তনখোলা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে পশ্চিম তীরবর্তী বেলতলা ও চরবাড়িয়া পয়েন্টের বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে আসছে। পশ্চিম তীরের লামছড়ি ও পোটকার চর এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবারের সূর্য উদীত হওয়ার আগেই কীর্তনখোলার পূর্বতীরের চরকাউয়া পয়েন্টের বাসিন্দারা প্রলয় দেখতে পেলেন চোখের সামনে। কিছু বুঝে উঠার আগেই পানির গর্জনের সাথে দোকানপাট, ফেরিঘাট ও খেয়াঘাটের সাথে বিলীন হয়ে গেল চরকাউয়া বাসস্ট্যান্ড। দু’ ডজন দোকানপাট বিলীন হয়েছে একদিনেই। এর মধ্যে নদীর কূল ঘেঁষে থাকা কয়েকটি দোকান মালামালসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চোখের সামনে নিজের দোকান মালামালসহ ভেসে যেতে দেখলেও তা রক্ষা করতে পারেননি অনেকেই। আড়িয়ল খাঁ নদের ভাঙ্গনে শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের কালীগঞ্জ, রাজাপুর ও আট হাজার তিনটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। মেহেন্দিগঞ্জের ভাষাণচর, বাগরজা, শিন্নির চর ও চর এককরিয়া নদী ভাঙ্গনের কবলে মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। উলানিয়া গ্রামটি মেঘনার ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পথে। সেখানকার কালিরবাজার নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পর এখন উলানিয়া মিয়া বাড়ি ও বড়বাজার হুমকির মুখে পড়েছে। গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ৯টি গ্রামের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১টি গ্রামের অস্তিত্ব আছে। ঐ গ্রামটিকে ৯টি গ্রামে বিভক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তাও ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ঐ এলাকায় তিন বছর পূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙ্গন রোধে একটি প্রকল্প গ্রহণ করলেও ঠিকাদার বিল না পাওয়ার অজুহাতে কাজ বন্ধ করে দেন। ফলে গৃহিত প্রকল্পের কাজসহ বহু স্থাপনা ভেসে যাচ্ছে মেঘনার গ্রাসে। মেঘনার ভাঙ্গনে উলানিয়ার অদূরবর্তী ভোলার বঙ্গের চর, রাজাপুর, দৌলতখান, গুপ্তের বাজার, সৈয়দপুর, ভবানীপুর, এমনকি খোদ ভোলা শহরের নিকটবর্তী ধনিয়া, কাঁচিয়া এখন বিলীন হওয়ার পথে। ভোলা শহর থেকে মেঘনার দূরত্ব এখন মাত্র ৬ কিলোমিটার। ভোলা শহর রক্ষায় কাঁচিয়ায় একের পর এক বেড়ি বাঁধ নির্মাণ ও ভাঙ্গন প্রতিরোধে ব্লক ফেলে মেঘনাকে শাসন করার চেষ্টা করা হলেও তা তেমন কাজে আসেনি।  বরং নতুন করে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে নাসির মাঝি এলাকায়। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলেই এসব এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে হু হু করে পানি ঢুকছে শহরতলীতে। তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙ্গনে বোরহানউদ্দিনের কাঁচিয়া, পক্ষিয়া, হাকিমউদ্দিন ও পদ্মা মনষা গ্রাম পড়েছে ঝুঁকির মুখে। শাহবাজপুরে গ্যাস ফিল্ডের কাছাকাছি চলে এসেছে নদীর ভাঙ্গন। ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তী আলিমাবাদ ইউনিয়নটি কালাবদর নদীর স্রোতে বিলীন হওয়ার পথে। পার্শ্ববর্তী চাঁদপুরা ইউনিয়ন রয়েছে হুমকির মুখে। মেঘনার ভাঙ্গনে পুরান হিজলা, চর মেমানিয়া, মৌলভীরহাট, গঙ্গাপুর, হরিনাথপুর, মল্লিকপুর, বাউশিয়া, বাহেরচর, হিজলা-গৌরবদী ও পালপাড়া গ্রামের কয়েক হাজার ঘর, ১১টি স্কুল এবং ৪টি হাট-বাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। মুলাদীর জয়ন্তি ও আড়িয়ল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে উপজেলার নন্দিবাজার, চরলক্ষ্মীপুর, পাতারচর, বানিমদন, নাজিরপুর, মৃধারহাট, ছবিপুর, গুলিঘাট ও বাটামারা গ্রামের ২ হাজার বাড়ি-ঘর, ৬টি বাজার ও ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনে বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠী সড়কটি ৭ বছরে আগে নদীগর্ভে বিলীন হয়। এখন সেখানে বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বাবুগঞ্জের সুগন্ধা, আড়িয়ল খাঁ ও সন্ধ্যা নদ-নদীর ভাঙ্গনে রাজগুরু, লোহালিয়া, ক্ষুদ্রকাঠী, বাহেরচর, ঘোষকাঠী, মহিষাদি, রাকুদিয়া, ছানি কেদারপুর, মোল্লারহাট, রহিমগঞ্জ, রফিয়াদি গ্রামের কয়েক হাজার বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বর্তমানে সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গনে চরম হুমকির মুখে রয়েছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের দোয়ারিকা এলাকার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গির সেতুসহ বরিশাল বিমানবন্দর, মেঘনা সংরক্ষণ বাঁধ, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ফেরিঘাট ও সড়ক। ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে একটি মসজিদ। অতিসমপ্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রী ঐ এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে ভাঙ্গন প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। সুগন্ধার ভাঙ্গনে হুমকিতে রয়েছে বরিশাল বিমানবন্দর ও আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় সেতু ও বিমানবন্দরকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপজেলা সদর ও মীরগঞ্জ বাজার থেকে সুগন্ধা নদীর দূরত্ব মাত্র ১শ’ গজ। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৫টিই নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। উজিরপুরে সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গনে বরাকোঠা ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম ও শিকারপুরের ১০টি গ্রাম এবং গুঠিয়া ইউনিয়নের দাসেরহাট, কমলাপুর, সাকরাল, পরমানন্দ গ্রামের ২০ হাজার ঘর-বাড়ি ও ৬টি স্কুল-মাদ্রাসা নদীতে বিলীন হয়েছে। ঐ উপজেলার সাকরাল গ্রামটি সম্পূর্ণ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শিকারপুর ও শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজ সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনে বানারীপাড়া উপজেলার কাজলাহাট, জম্বুদ্বীপ, ব্রাহ্মণকাঠী, নাজিরপুর, শিয়ালকাঠী, মসজিদ বাড়ির ১৫ হাজার ঘর, ৮টি স্কুল-মাদ্রাসা ও ২টি বাজার গত তিন বছরে  নদীগর্ভে বিলীন  হয়েছে। উজিরপুরের সাকরাল গ্রামের বাসিন্দারা জানান, প্রতি বছর আষাঢ় মাস এলেই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়। এবারো নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। বাকেরগঞ্জের তাণ্ডব, খয়রাবাদ, বেবাজ, কাতিভাঙ্গা, রাঙ্গামাটি, কারখানা ও তুলাতলি নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। নদীর কড়াল গ্রাসে হুমকির মুখে রয়েছে কলসকাঠী, বোয়ালিয়া, বাখরকাঠী, নীলগঞ্জ, চরামদ্দি এলাকার কয়েক হাজার বাড়ি-ঘর। প্রতিবছর নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও তা ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের পকেটে যায় বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, ভাঙ্গন প্রতিরোধে কখনোই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বসতভিটা হারানো মানুষদের অভিযোগঃ স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত যে পরিমাণ টাকা নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সে টাকায় ভাঙ্গন কবলিত গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষদের পুনর্বাসন করা সম্ভব হতো। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙ্গনের শিকার হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ২/১ কিলোমিটার দূরে গিয়ে নতুন বেড়ি বাঁধে বসতি গড়েন। কিন্তু মাত্র ২/১ বছরের ব্যবধানে নদী  আবার সেখানে আঘাত হানে। এভাবেই একের পর এক ভাঙ্গনের শিকার হয়ে অসহায় মানুষ এক পর্যায় গ্রাম ছেড়ে বাধ্য হয়ে  রুটি রুজির সন্ধানে রাজধানী ঢাকা কিংবা বিভাগীয় কোনো বড় শহরে পাড়ি জমায়। এদের ঠাঁই হয় বস্তিতে। নদী ভাঙ্গনের শিকার ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়া উপকূলীয় বিভাগ বরিশালে দারিদ্র্যের হার ৫২ ভাগ। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর সাথে সাথেই প্রবল বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানিতে প্রথম দফা ভাঙ্গন শুরু হয়। এরপর উজানের পানি নামতে শুরু করায় ভাঙ্গন আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে।  ভাঙ্গনে শুধু মানুষের বসতঘর আর প্রতিষ্ঠান হারাচ্ছে না। হারিয়ে যাচ্ছে নদী তীরবর্তী, শত শত একর ফসলী জমি, রাস্তা-ঘাট ও ফলজ বাগান। চরকাউয়া ও চরবাড়িয়ার নদী ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন সদর আসনের সংসদ সদস্য জেবুনেচ্ছা আফরোজ। তিনি জানান, গত বছর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে ভাঙ্গন প্রতিরোধের আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সাথে সাক্ষাৎ করে জলবায়ু ট্রাস্ট থেকে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ এনেছেন। ঐ টাকায় খুব শিঘ্রই পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ)  জহির উদ্দিন আহমেদ জানান, বরিশালের ১০ উপজেলার ২৬টি পয়েন্টের নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ প্রকল্পের জন্য ৪’শ ১০ কোটি টাকার চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্টের ৩ কোটি টাকা দিয়ে বেলতলা পয়েন্টের কাজ করা হবে। জরুরি ভাঙ্গন প্রতিরোধ প্রকল্পে পাওয়া গেছে ২৩ লাখ টাকা। এ টাকায় জরুরি ভাঙ্গন প্রতিরোধ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া হবে।
হটনিউজ২৪বিডি.কম/এআর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top