সকল মেনু

বারবার যে কারণে ভূমিকম্প হচ্ছে

EarthQuake1430075706 অাছাদুজ্জামান,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: নেপালে  শনিবারের ভূমিকম্পের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের গবেষকেরা এ অঞ্চলে আরো শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রজার বিলহাম সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ২৫ এপ্রিলের এই ভূমিকম্প আরো বড় কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাবস্থাও হতে পারে। এমনকি এই ভূমিকম্পের আফটার শক (পরাঘাত) আগামী দুই মাস পর্যন্ত যেকোনো সময় আসতে পারে।

পোখারায় শনিবার ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পর রোববার দুপুরে ফের নেপালে ভূমিকম্প হয়েছে। এর তীব্রতা ছিল ৬ দশমিক ৬। এরপর রাত ১০টার দিকে তৃতীয় দফা ভূমিকম্প হয়েছে সেখানে। এর তীব্রতা ছিল অপেক্ষাকৃত কম ৫ দশমিক ৪। গত ৮০ বছরের মধ্যে নেপালে শনিবারের ভূমিকম্পই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু গবেষকদের আশঙ্কা সেখানে এর চেয়েও শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে।

সাধারণত ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীরনের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হটাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প (Earthquake) বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক/দু-মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দূর্বল হয়, তা অনুভব করা যায় না।

গবেষকেরা বলছেন, ১০ কোটি টন টিএনটি বিস্ফোরিত হলে যে শক্তি নির্গত হয় ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে সে মাত্রার কম্পন হয়েছে। হায়দরাবাদভিত্তিক ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক হার্শ কে গুপ্ত বলেন, ‘এই অঞ্চলে বিশাল চ্যুতির কথা আমরা জানি, যা বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটায়। রিখটার স্কেলে ৮ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য এই চ্যুতিগুলো দায়ী। সে হিসেবে এই অঞ্চলের সম্ভাব্য শক্তিশালীতম ভূমিকম্পের মধ্যে এটি পড়ে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো সময় এ ধরনের ভূমিকম্পের পরাঘাত আসতে পারে। ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার দুই মাস পরেও এ ধরনের ঝুঁকি থেকে যায়। এ ধরনের পরাঘাত বা কম্পন কখন হবে, তা বলা সম্ভব নয়। এটি প্রতিরোধেরও কোনো উপায় নেই।

কেন বারবার হিমালয় কন্যা ছোট্ট দেশ নেপালে কেন ঘন ঘন ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক কারণেই এটি ঘটছে। আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ভারত একটি আলাদা দ্বীপ ছিল, যা দ্রুত সরে এসে এশিয়ার সঙ্গে ধাক্কা খায়। মধ্য এশীয় টেকটোনিক প্লেটের নিচ দিয়ে ভারতীয় প্লেট অতি ধীরে ধীরে ঢুকে যাওয়ার ফলে এখানকার পর্বতগুলো এখনো আকার পাচ্ছে। প্রতি বছর এই দুটি প্লেট দুই ইঞ্চি করে পরস্পরের দিকে সরে আসছে। এতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড চাপ। টেকটোনিক প্লেট হচ্ছে ভূত্বকের বিশাল খণ্ড, যা সঞ্চরণশীল।

যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড রথারি বলেন, হিমালয়ের পর্বতমালা ভারতীয় প্লেটের ওপর দিয়ে প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। সেখানে দুই থেকে তিনটি বড় ধরনের চ্যুতি রয়েছে। আর আছে কিছু খুব মৃদু গতিতে সঞ্চরণশীল চ্যুতি। এগুলোর সঞ্চরণের কারণেই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে।

কয়েক দশক ধরেই নেপালের কাঠমান্ডুর মানুষকে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, টেকটোনিক প্লেটের এই সংঘর্ষে নেপালের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ, সেখানকার ভূমির গঠনই ভূমিকম্পের এই ঝাঁকিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। নেপালে যেভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়, তা এই ঝাঁকি থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।

শনিবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল কম। ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ১৫ কিলোমিটার নিচে এর উৎপত্তিস্থল। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হয়েছিল। মূল ভূমিকম্পের পর চার ঘণ্টা পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪টি কম্পন রেকর্ড করেন গবেষকেরা। ৬ দশমিক ৬ মাত্রার একটিসহ কম্পনগুলোর মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫। পরবর্তী কম্পনগুলোর শক্তি ৩০ গুণ কমে গেলেও যেসব ভবন এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো পরবর্তী ছোট কম্পনেও ধসে পড়ার জন্য যথেষ্ট।

হিমালয় অঞ্চলের অধিবাসীদের বেশির ভাগই যে ধরনের অবকাঠামোতে বাস করে, সেগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত এগুলো দুর্বল ইট ও চুনসুরকি দিয়ে তৈরি। আগের অভিজ্ঞতা থেকে আরেকটি বড় ধরনের যে উদ্বেগ রয়েছে তা হলো, এখানে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এ পার্বত্য অঞ্চলে এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেগুলো পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। এসব গ্রাম মাটি ও পাথরের নিচে চাপা পড়ে একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

জিওহ্যাজার্ডস ইন্টারন্যাশনাল নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার মতে, প্রতি ৭৫ বছর পর পর নেপালসহ ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত হানছে। ৮১ বছর আগে ১৯৩৪ সালে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে নেপালের ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল এভারেস্ট থেকে ছয় মাইল দক্ষিণে। ১৯৮৮ সালে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে এক হাজার মানুষ মারা যান।

এশিয়া অঞ্চলের ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রজার বিলহাম। তিনি বলেন, ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্প এক থেকে দুই মিনিট স্থায়ী ছিল। কাঠমান্ডুর নিচ দিয়ে প্রায় ৭৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত চ্যুতির মধ্যে ভূত্বকের এই খাঁজটি প্রায় ১০ ফুট পর্যন্ত সরে গেছে। এতে কাঠমান্ডু শহর দক্ষিণ দিকে প্রায় ১০ ফুট সরে গেছে।

বাংলাদেশে আটটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যেমন বগুড়ার চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা। বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মিয়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top