সকল মেনু

খুলনায় আশঙ্কাজনকহারে সীসা ফ্যাক্টরীর বিস্তার ঘটেছে

খুলনা প্রতিনিধি : নিয়ম-কানুন না মেনেই খুলনায় একের পর এক সীসা ফ্যাক্টরী গড়ে উঠছে। এসব ফ্যাক্টরী থেকে নির্গত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ, মানুষ ও পশুর স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এছাড়া ফ্যাক্টরীর অবশিষ্ট অংশ ও ভারী ধাতু বিষক্রিয়া ছাই-এর সাথে বাতাসে উড়ে গিয়ে আশপাশের কৃষি জমিতে পড়ছে। আর ওই জমিতে জন্মানো ঘাস কোনো পশু খেলে ওই পশু অসুস্থ হয়ে পড়ছে অথবা মারা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের যৌগ মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর কোনো পশু ফ্যাক্টরীর আশপাশের ঘাস খেলে ওই পশু মারা যেতে পারে। সূত্রে প্রকাশ, খুলনা মহানগরী এলাকায় হঠাৎ করে ইজিবাইকের প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় আশঙ্কাজনকহারে সীসা ফ্যাক্টরীর বিস্তার ঘটেছে। খুলনার শহরতলীর আবাসিক এলাকা রূপসা, লবণচরা, হরিণটানা, তেঁতুলতলা, সুড়িখালী, হোগলাডাঙ্গা, শোলমারী, আড়ংঘাটা, বিল পাবলা, রায়েরমহল, শিরোমনিসহ বিভিন্ন উপজেলায় রাতারাতি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অবৈধ সীসা ফ্যাক্টরী। এসব ফ্যাক্টরীতে ইজিবাইকে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত ব্যাটারী জড়ো করা হয়। প্রথমে ব্যাটারীর মধ্যে থাকা সীসার (রাসায়নিক নাম লেড) পাতগুলো বের করে আলাদা করা হয়। আলাদা করা পাতগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় গলিয়ে সীসা এবং লোহা পরিমাণ অংশ পৃথক করা হয়। পরবর্তীতে পৃথককৃত ওই সীসা আবারো ব্যাটারী তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার অনেক ইট ভাটাতেও এ সীসা জ্বালানো হচ্ছে। আর ওই সীসা উচ্চ তাপমাত্রায় গলানোর সময় সহযোগী হিসাবে কার্বণ মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর যৌগ উৎপাদিত হয় এবং তা দ্রুত বাতাসের সাথে চারিদিকে এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুডে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ফ্যাক্টরী থেকে নির্গত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ, মানুষ ও পশু স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিকাংশ মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ দেখা দিচ্ছে। এছাড়া ফ্যাক্টরী থেকে নির্গত অবশিষ্ট অংশ আশে পাশের কৃষি জমিতে পড়ছে। আর ওই কৃষি জমিতে জন্মানো ঘাস কোনো পশু খেলে ওই পশু অসুস্থ বা মারা যাচ্ছে। তবে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা নামে-বেনামে গড়ে ওঠা ওইসব অবৈধ ফ্যাক্টরীগুলোতে কি করা হচ্ছে তা সহজে জানতে পারে না সাধারণ মানুষ। এসব ফ্যাক্টরীগুলো দিনের বেলায় সাধারণত তালাবদ্ধ থাকে। সুড়িখালী এলাকার বাসিন্দা বাবুল হাওলাদার ও কে এম তাছাদুজ্জামান জানান, সীসা ফ্যাক্টরীগুলো সারাদিন বন্ধ থাকে। মধ্যরাতে গাড়িতে করে মালামাল এনে কাজ শুরু করা হয়। আবার ভোর হওয়ার আগেই কাজ শেষ করে দেয়া হয়। রাতে যখন তারা কাজ করে তখন ওই এলাকা আলোতে ঝলমল করে। বাতাসে গন্ধ আসলে মানুষের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এছাড়া ফ্যাক্টরীর অবশিষ্ট অংশ ও ভারী ধাতু বিষক্রিয়া ছাই-এর সাথে বাতাসে উড়ে গিয়ে আশপাশের কৃষি জমিতে পড়ছে। আর ওই জমিতে জন্মানো ঘাস কোনো পশু খেলে ওই পশু অসুস্থ হয়ে পড়ছে অথবা মারা যাচ্ছে। হোগলাডাঙ্গা ও ডুমুরিয়া এলাকার বাসিন্দা ভবতোষ মন্ডল ও আনিছুজ্জামান জানান, মধ্যরাতে ফ্যাক্টরী ও ইট ভাটাতে কাজ চলার সময়ে বাতাসে গন্ধ ছড়ালে মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে বলে বিষয়টি বুঝতে পারে না। শিরোমনি এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, সীসা ফ্যাক্টরী কারনে গাছপালার পাতা বিবর্ণ হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় চৈত্র মাসের কাটফাঁটা রোদ্রে এ অবস্থার সৃষ্ট হয়েছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সিনিয়র ভেটেরিনারী সার্জন ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম জানান, সীসা জ্বালালে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বের হয়। আর ওই পদার্থ পার্শ্ববর্তী জমিতে আসলে আর ওই জমির ঘাস কোনো পশু খেলে সেই পশু অসুস্থ বা মারা যেতে পারে। খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ সৈয়দ মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ব্যাটারী সীসা উচ্চ তাপমাত্রায় গলালে সেটি ভারী ধাতু বিষক্রিয়া হয়। অনেক সময় ছাই-এর সাথে বিষাক্ত সীসা বাতাসের উড়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জমিতে পড়ে। বিশেষ করে শীতকালে উড়ে যাওয়া সিসা পাশের জমিতে পড়লে আর স্থানান্তরিত হয় না। ফলে ওই স্থানে জন্মানো ঘাস কোনো পশুতে খেলে ওই পশু অসুস্থ বা মারা যেতে পারে। ২০০৭ সালে নগরীর বুড়ো মৌলভীর দরগা এলাকায় এমনিভাবেই এক সঙ্গে ১২টি গরু মারা গিয়েছিলো বলে তিনি জানান। খুলনা সিভিল সার্জন ডাঃ ইয়াছিন আলী সরদার বলেন, সীসা উচ্চ তাপমাত্রায় গলানোর সময় সহযোগী হিসাবে কার্বণ মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বণ ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর যৌগ উৎপাদিত হয় এবং তা দ্রুত বাতাসের সাথে চারিদিকে এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুডে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের যৌগতে পরিবেশ দুষিত হয়। যার কারণে মানুষের মধ্যে কঠিনতম রোগ এ্যাজমা, চোখের রোগ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন জানান, খুলনা বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের সীসা ফ্যাক্টরী গড়ে উঠেছে। এছাড়া বাড়ির আশপাশসহ বিভিন্ন ইটভাটাতেও অস্থায়ীভাবে সিসা পুড়ানো হচ্ছে। যা পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তরে লোকবল কম। রাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা নিষিদ্ধ থাকায় এ গুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নামী-দামী কিছু কোম্পানি এসব ফ্যাক্টরীর কাছ থেকে কম দামে সীসা ও ব্যাটারী কেনায় অবৈধ ফ্যাক্টরীর সংখ্যা বাড়ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top