সকল মেনু

নতুন হোঁচট খেল পুরোনো স্টাইলেবিএনপি

 নিজস্ব প্রতিবেদক: নতুন বছরে নব উদ্যমে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই পুরোনো স্টাইলে নতুন করে হোঁচট খেল বিএনপি। পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলেও হঠাৎ করেই আন্দোলনের প্রাক-প্রস্তুতিতে ছন্দপতন ঘটেছে দলটির। জানা গেছে, একের পর এক শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং তাদের বাসায় পুলিশের অব্যাহত হানায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এটাকে সরকারবিরোধী এক দফা আন্দোলনের আগে বড় ধরনের ‘হোঁচট’ হিসেবে দেখছেন তারা।

গ্রেফতার অভিযানের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান হটনিউজ২৪বিডি.কমকে  বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা সরকারের নতুন নয়। তাদের এই আচরণ অনুমানের বাইরে নয়। এটা প্রত্যাশিত নয়, উচিতও নয়। কিন্তু সরকার উচিত-অনুচিতের ধার ধারে না। যা খুশি তা-ই করে। তবে এই ঘটনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না।’

দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি মূলত ৩ ও ৫ জানুয়ারির জনসভার জন্য অপেক্ষা করছে। ওই জনসভা শেষে বিএনপি প্রধান সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি নির্বাচনের পন্থা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বের করার আহ্বান জানিয়ে সরকারকে স্বল্পমেয়াদি আলটিমেটাম দেবেন।

এতে সরকার সাড়া না দিলে লাগাতার কঠোর আন্দোলনে যাবে বিএনপি। সেজন্যই গাজীপুরে বিএনপির সমাবেশে বাধা আসার পর যেকোনো মূল্যে জনসভার হুংকার দিয়েও পরে পিছু হটে দলটি। গাজীপুরে হরতাল দিয়ে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। যদিও এক দিন পর একই ইস্যুতে এবং গ্রেফতার হওয়া নেতাদের মুক্তির দাবিতে সোমবার দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয় বিএনপি নেতৃত্বধীন জোটটি।

তবে সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপির এই ‘দোদুল্যমান অবস্থান’ নিয়ে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, গাজীপুরে খালেদা জিয়ার জনসভাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের চ্যালেঞ্জের মুখে দলের নেওয়া অবস্থানে খুশি নন তারা। গাজীপুর ইস্যুতেই কঠোর আন্দোলনে যাওয়া উচিত ছিল- এমন মতামত জানিয়ে বিএনপির বেশ কয়েকজন মাঠ পর্যায়ের নেতা জানিয়েছেন, তারা এই ইস্যুতেই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু দল আন্দোলন থেকে আবারও পিছু হটায় তারা হতাশ হয়েছেন। তাদের মতে, ওই দিনই নিষেধাজ্ঞা ভাঙা উচিত ছিল।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা জানিয়েছেন, জানুয়ারিতে বিএনপি ঢাকায় বড় দুটি সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গাজীপুরের জনসভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারির পর দলের নেওয়া অবস্থানকে সঠিক মন্তব্য করে দলের ওই নেতা বলেন, এটিকে বিএনপির পিছুটান বলা যাবে না। বরং আন্দোলন প্রশ্নে দলের এটি অন্যতম একটি ‘কৌশল’।

তবে আন্দোলনের আগেই গাজীপুরে জনসভা ইস্যুতে ‘পিছু হটা’ এবং বকশীবাজার সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং তাদের বাসায় পুলিশের তল্লাশিতে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বিএনপি।

ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আউয়াল মিন্টু, মহনগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, প্রাক্তন ছাত্রদল নেতা আজিজুল বারী হেলালের বাসায়।

সূত্র জানায়, দু-এক দিনের মধ্যে গ্রেফতার হতে পারেন আরো বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল নেতা। এ ছাড়া গ্রেফতার হতে পারেন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতার-আতঙ্কে এই মুহূর্তে আত্মগোপনে চলে গেছেন বিএনপির প্রথম সারির বেশ কিছু নেতা, যাদের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করে দল।

গয়েশ্বর ও আলাল গ্রেফতার এবং নেতাদের বাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর সচরাচর দেখা যাচ্ছে না ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসকে। রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে সিঙ্গাপুর বিএনপির একটি অনুষ্ঠানে আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি।

একইভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকতউল্লাহ বুলু, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবুল খায়ের ভূইয়া, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, যুবদল সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান এবং সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান।

এ ছাড়া থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা নিজেদের নিয়ে গেছেন আড়ালে। পুলিশের এই আকস্মিক গ্রেফতার অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহানগর বিএনপির পুনর্গঠনের কাজ। জানুয়ারির শুরুতেই পুনর্গঠনের কাজ শেষ করার নির্দেশ ছিল হাইকমান্ডের।

মহানগর বিএনপির এজকন শীর্ষ নেতা হটনিউজ২৪বিডি.কমকে বলেন, দল নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোলেও এই মুহূর্তে কিছুটা ছন্দপতন হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে, ঢাকা মহানগর বিএনপির পুনর্গঠন প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এ অবস্থায় গ্রেফতার অভিযান দলের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি জানান, বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভা করে শান্তিপূর্ণভাবেই সরকারকে একটি মেসেজ দিতে চেয়েছে। কিন্তু সরকার যা শুরু করেছে তাতে বিএনপির নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

মহানগর ওই নেতার মতো করেই দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবেই বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অতি ‘ডিফেন্সিভ মুড’ আবারও কাল হয়ে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে নেতা-কর্মীদের বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। এর মানে কী? মানে, তারা আন্দোলনের আগেই বিএনপিকে কোণঠাসা করতে চায়। তাই এই মুহূর্তে আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে।’

তবে আন্দোলনের সময় নিয়ে কেন্দ্র ‘দোদুল্যমান’ হলেও এখনই আন্দোলন চান মাঠ পর্যায়ের নেতারা। যেমনটি বলছিলেন নাটোর বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দস তালুকদার দুলু।

হটনিউজ২৪বিডি.কমকে তিনি বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে হতাশ, আন্দোলন চায়। তারা গাজীপুর ইস্যুকে কেন্দ্র করেই আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছে। সেজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। ওই দিন ১৪৪ ধারা ব্রেক করা উচিত ছিল। নেতা-কর্মীরা আন্দোলনের জন্য মুখিয়ে আছে।’

একই সুরে বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাড. মজিবুর রহমান সারোয়ার হটনিউজ২৪বিডি.কমকে  বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা ধৈর্য মানছেন না। অব্যাহত গ্রেফতার-নির্যাতনে তারা আন্দোলনের জন্য মুখিয়ে আছেন। তারা কঠোর আন্দোলনের ডাকের অপেক্ষায় রয়েছেন।’

আন্দোলনের জন্য তৃণমূল কতটা মুখিয়ে আছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে হবিগঞ্জে। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র, জেলা বিএনপির সেক্রেটারি জি কে গউছকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে হবিগঞ্জ শহর।

আমাদের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গউছের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় পুলিশের ওপর চড়াও হয় স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এতে সদর থানার ওসি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে ১০টি গাড়িও ভাঙচুর করে গউছ-সমর্থকরা। এ সময় ১০ জনকে আটক করে পুলিশ।

এদিকে বিএনপি নেতৃত্বধীন জোটের সোমবারের ডাকা হরতালকে দেখা হচ্ছে আন্দোলনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে। এই আন্দোলনে বিএনপি সরকারকে কী ম্যাসেজ দিতে পারল, তার ওপরই নির্ভর করছে দলটির সরকারবিরোধী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ, এমনটিই মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতার অভিযান ও নেতাদের আত্মগোপনে সোমবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে নেতারা কতটা রাজপথে থাকতে পারবেন, তা নিয়ে দলেই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও দলটির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হরতালে নেতারা মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি কোনো ভুঁইফোড় সংগঠন নয়।  বিএনপির নেতারা ঘরে বসে নেই, কালকেও সবাই মাঠে থাকবে।’

নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার-আতঙ্ক ভবিষ্যৎ আন্দোলনে কোনো প্রভাব ফেলবে না- দাবি করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই সরকার নির্বাচিত নয়, তাই জনগণের কাছে তারা দায়বদ্ধও নয়। কারণ তারা জানে, গণতান্ত্রিকভাবে তাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। সেজন্য এই সরকার জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এটা নিয়ে বিএনপি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয়।’

গ্রেফতারের মাধ্যমে সরকার অগণতান্ত্রিক আচরণ করছে- মন্তব্য করে দলটির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান হটনিউজ২৪বিডি.কমকে বলেন, এর ফলে দেশে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। তাই সরকারের যত দ্রুত শুভবুদ্ধির উদয় হবে ততই মঙ্গল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top