সকল মেনু

ক্ষমতাশীনরা দুদকের সামনে দেয়াল

18

দুর্নীতি অনুসন্ধান ও তদন্তে কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাধীন সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদবির ও স্বজনপ্রীতির কারণে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাধরদের দুর্নীতি অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদক ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রর’ ভূমিকা পালন করছে। আবার একই কারণে দুদক কারও কারও বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লাগছে।
এ ছাড়া তদন্তের মাঝপথে প্রমাণ না মেলায় ‘মামলা করা ভুল ছিল’ সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার নজিরও রেখেছে দুদক। সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নেতৃত্বে দৃঢ়তার অভাবেই দুদক জনগণের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সম্প্রতিকালে ক্ষমতাসীন দল, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় নিয়ে আসায় দুদক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তবে ফল অর্জনের ক্ষেত্রে দুদক সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতি ও প্রশাসনিক চাপ এবং নেতৃত্বে দৃঢ়তার অভাবে দুদক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। অনেক সময় দুদকের অবস্থান ও সরকারের অস্থান অনেকাংশে এক হয়ে যায়। এ সব ক্ষেত্রে কমিশনকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান কমিশন পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। এর আগে কখনো ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীদের দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। বর্তমান কমিশন তা করেছে। দুদক কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।’
দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতায় দুদক দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। কোনো সমালোচনা যদি ভালো কিছু বয়ে আনে তাহলে আমরা তা সাধুবাদ জানাই। তবে কমিশন কারও সমালোচনাকে পরোয়া করে না।’
সারাদেশে ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্য, প্রতারণা, জালিয়াতি লাগামহীনভাবে চললেও দুদক চলছে ঢিমেতালে। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ২০০৯ সালের ২৪ জুন দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাকে ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্র’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এখনো পর্যন্ত ওই আখ্যা পাল্টাতে পারেনি কমিশন। অনেক কর্মকর্তা অনুসন্ধান ও তদন্তে পরাধীনতার কারণে এখনো নখ-দন্তহীন বলেই আখ্যায়িত করেন।
ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির অভিযোগ হরহামেশাই আটকে যাচ্ছে অথবা নথিভুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে কিংবা মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
দুদক সূত্র জানায়, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মো. এনামুল হকের (রাজশাহী-৪ আসন) অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার সুপারিশ অনুসারে কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. নাসিরউদ্দীন আহমেদ মামলার অনুমোদন দিলেও আরেক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর দ্বিমতের কারণে এখনো পর্যন্ত তা আটকে আছে। বিষয়টি সমাধানে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান একাধিকবার ওই দুই কমিশনারের সঙ্গে জরুরি মিটিং করেও এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের স্থান নেই। দুদক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাধীন সংস্থা। দুদকের কোনো কাজে সরকার কখনো হস্তক্ষেপ করেনি এবং করবেও না। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক না কেন দুদক কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।’
পেট্রোবাংলার অধীনে ১৩টি প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক চেয়ারম্যান হোসেন মনসুরসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন না দিয়ে পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মামলার সুপারিশকারী ওই কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে আইনি লড়াইয়ে জিতে ১৮ বছর পর সম্পদের হিসাব জমা নেওয়া হয়েছে এলডিপি সভাপতি ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদের কাছ থেকে। চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দুদকে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘মন্ত্রিসভার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় হয়ত তাকে দুদকে আসতে হয়েছে।’
দ্রুতগতিতে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের। ২০০৬ সালে জোট সরকারের সময় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের ৮৯৭টি প্লট বরাদ্দে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ২০১২ সালে এর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সম্প্রতি অনুসন্ধানের জন্য নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানটি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সমবায় সমিতির প্লট বরাদ্দে অনিয়মের মামলায় মির্জা আব্বাসসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের সুপারিশ করেছে কমিশনের তদন্তকারী কর্মকর্তা, যা অনুমোদনের অপেক্ষাধীন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মোছাদ্দেক আলী ফালু ও নুরুল ইসলাম মনির বিরুদ্ধে গুলশানের প্লট (রোড নং-৪১, প্লট নং-৪৩, গুলশান মডেল টাউন) অবৈধভাবে দখল ও রাজউকের সহায়তায় তা বিক্রি করে অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধান গতি পেয়েছে। সম্প্রতি অভিযোগ অনুসন্ধানে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও তার প্রবাসী ভাই মঞ্জুর আহমদের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশানে বাড়ি দখলের অভিযোগ দ্রুত অনুসন্ধান করে মামলা এবং তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, বহুল পরিচিতি সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারির মূল ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ও দুদকের হলমার্ক মামলার আসামি সোনালী ব্যাংকের এমডি ও সিইও প্রদীপ কুমার দত্তের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নথিভুক্ত করে দুর্নীতির দায় থেকে তাকে রেহাই দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘দুদক এখন দায়মুক্তির কমিশনে পরিণত হয়েছে। দুদকের মামলাসহ বিগত দিতে সরকার সাত হাজার ৫০০ মামলা প্রত্যাহার করিয়েছে। সরকারদলীয়দের বেলায় দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিলেও তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ার অজুহাতে তাদের ছেড়ে দিচ্ছে ‍দুদক।’
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় তারা (দুদক) আসামিদের দায় থেকে মুক্তি দিলেও কানাডায় এ সংক্রান্ত মামলা এখনো চলছে। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া সম্পদের হিসাবে ভুল হয়েছে—এ কথা সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা বললেই দুদক তা মেনে নিচ্ছে। দুদক স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না।’
একই সময় মিডিয়া ও বিশ্বব্যাংকের ওপর দোষ চাপিয়ে পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেষ পর্যন্ত হাত গুটিয়ে নিয়েছে দুদক। তবে কমিশনের অনেক কর্মকর্তাই একে কলঙ্কিত অধ্যায় বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেতু দুর্নীতি মামলার এফআরটি (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দাখিলের মাধ্যমে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। মামলার আসামি হিসেবে না থাকলেও আসামিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের বিষয়টি মামলার এজাহারে উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়াসহ এজাহারভুক্ত সাত আসামি এ দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় (মামলা নং-১৯) মোট সাতজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছিল দুদক।
এ ছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিভিন্ন সময় প্রকাশিত জরিপে পুলিশ ও রাজস্ব কর্মকর্তারা দুর্নীতির শীর্ষে বলে চিহ্নিত হলেও এদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বেশিরভাগ অনুসন্ধান ও তদন্তই আলোর মুখ দেখে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top