সকল মেনু

ইসলামের দৃষ্টিতে দেশপ্রেম ও স্বদেশ চেতনা

9

হটনিউজ২৪বিডি.কম,ডেস্ক: ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। মা, মাতৃভূমি ও মায়ের ভাষার প্রতি মানুষের সহজাত আকুতিকেও ইসলাম শ্রদ্ধা করে। ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’- বাক্যটি হাদিসের অন্তর্ভুক্ত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; কিন্তু দেশের প্রতি আত্মিক প্রেরণা ও ভালোবাসাকে ইসলাম কখনো অস্বীকার করে না। দেশপ্রেমের ইংরেজি প্রতিশব্দ Patriotism. গ্রিক patria শব্দ থেকে Patriotism শব্দের উৎপত্তি। Patria অর্থ হচ্ছে The land of one’s Fathers (কোনো ব্যক্তির পিতৃপুরুষদের জন্মভূমি)। Mike Wasdin নামক প্রখ্যাত রাজনীতিবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে Patriotism বা দেশপ্রেম হচ্ছে ‘a Feeling of love and devotion to one’s own homeland.’

দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদাবোধ স্বাধীন-সার্বভৌম যেকোনো দেশের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ। দেশের প্রতি যার অন্তরে ভালোবাসা বিদ্যমান, উত্তরোত্তর দেশের মঙ্গল, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা তার সহজাত বিষয়। দেশীয় সংস্কৃতি লালন, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সচেতন থাকা, দেশ ও গণমানুষের শত্রুদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা, প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা দেশপ্রেমের অনুপম দৃষ্টান্ত।

ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

প্রেম-ভালোবাসার শক্তি অসীম ও পরাক্রম। ভালোবাসা যেভাবে মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহস জোগায়, তেমনি ভালোবাসা মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে ‘ভয়ংকর’ সাহসী করে তোলে। আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেমহীন সম্পর্ক বিলীন করে দেয় পরিবারের সব শান্তি। পরিবারে পারস্পরিক হৃদ্যতা, স্নেহ-প্রীতি ও ভালোবাসা না থাকলে পৃথিবী একখণ্ড নরকে পরিণত হয়। রাজা-প্রজায় ভালোবাসাবিবর্জিত সম্পর্কে ধ্বংস হয়ে যায় দেশের স্থিতিশীলতা। হুমকির মুখে পড়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ঠিক তেমনি দেশপ্রেম না থাকলে ব্যাহত হয় দেশের অগ্রযাত্রা। অচল হয়ে পড়ে দেশের সাফল্য ও সমৃদ্ধির চাকা। আর যেহেতু হজরত আদম (আ.)-কে পৃথিবীতে আল্লাহর ‘খলিফা’ বা ‘প্রতিনিধি’রূপে প্রেরণ, অতঃপর একের পর এক নবী-রাসুলগণের আগমন এবং শতাধিক ঐশীগ্রন্থ অবতরণ করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার বুকে শান্তিশৃঙ্খলা ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি আমার রাসুলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত ২৫) তাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, জনগণের সংশোধন, ইসলামী আইন ও দণ্ডের বিধান কার্যকর করার জন্য একটি ভূখণ্ডের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। এই ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা, তার বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সামরিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে অগণিত মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আমরা পেয়েছি, তার মূলেও রয়েছে মুক্তিকামী জনতার নিখাদ দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ। যার কাঙ্ক্ষিত পরিণতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

আল কোরআনে স্বদেশ চেতনা

আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকেই একেকটি অঞ্চলে দীনের দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। হজরত মুসা (আ.)-এর জাতি ও দেশ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “স্মরণ করো, যখন মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছিলেন এবং তোমাদের রাজত্বের অধিকারী করেছিলেন। আর বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি প্রদান করেননি, তা তোমাদের দিয়েছেন।” (সুরা মায়িদা, আয়াত ২০)

অনুরূপভাবে নুহ (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি তো নুহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে। সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায় আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই। তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না’।” (সুরা মুমিন, আয়াত ২৩)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি।’ (সুরা ইব্রাহিম, আয়াত ৪) উদ্ধৃত আয়াতগুলোতে ‘কাওমিহি’ বা ‘স্বজাতি’ শব্দটি ব্যবহার দ্বারা দেশ, দেশের মানুষ, দেশের ভাষা ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে কাউকে নিজ দেশ ও মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করা ইসলামের চোখে খুবই গর্হিত অপরাধ। তাই মক্কার কাফির কর্তৃক স্বদেশভূমি মক্কা থেকে রাসুল (সা.)-কে বিতাড়নের চেষ্টাকে কোরআনে ষড়যন্ত্র ও অন্যায় হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা অথবা নির্বাসিত করার জন্য। তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন; আর আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত ৩০)

মাতৃভূমির প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসা

পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত, তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’ (তিরমিজি, ৩৯২৬)

অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ বিন আদি বিন হারাম (রা.) বলেন, “আমি রাসুল (সা.)-কে ‘খাজওয়ারা’ নামক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! (হে মক্কা) আল্লাহর জমিনে তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ… যদি তোমার কাছ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া না হতো, তবে আমি তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতাম না’।” (তিরমিজি, ৩৯২৫) এ আবেগময় বেদনাকাতর অভিব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অন্য হাদিসে হজরত আনাস (রা.) বলেন, “আমি খায়বর অভিযানে খাদেম হিসেবে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে গেলাম। অভিযান শেষে রাসুল (সা.) যখন ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বললেন, ‘এই পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি’।” (বুখারি, ২৮৮৯) হিজরত করে মদিনায় গমন করার পর রাসুল (সা.) প্রায়ই মক্কায় ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘যিনি তোমার জন্য কোরআনকে (জীবন) বিধান বানিয়েছেন, তিনি তোমাকে অবশ্যই তোমার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।’ (সুরা কাসাস, আয়াত ৮৫) রাসুল (সা.)-এর সাহাবিগণও নিজ দেশকে খুবই ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরাক্রান্ত হলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের মনে স্বদেশভূমি মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠল। তাঁরা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। তাঁদের এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসা মদিনার প্রতি আমাদের অন্তরে দান করুন।’ (বুখারি, ৬৩৭২) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ধর্ম-বর্ণ ও দল-মত নির্বিশেষে ইস্পাতকঠিন ঐক্য ও অনন্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে যাঁরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যাঁরা আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন, হৃদয়ের গহিন থেকে তাঁদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top