সকল মেনু

জীবন বীমা: ৮০ শতাংশ পলিসিই তামাদি

ঢাকা :: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জীবন বীমা খাতে তামাদি পলিসির হার সাধারণত ২০ শতাংশে সীমিত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে তামাদি পলিসির হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মোট পলিসির ৮০ শতাংশেরও বেশি।

কোনো কোনো কোম্পানিতে তামাদির পরিমাণ নতুন পলিসি বিক্রির চেয়েও বেশি। মূলত মাঠপর্যায়ে বীমা প্রতিনিধিদের অদক্ষতা, অসাধু প্রতিযোগিতা ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে এমনটি হচ্ছে।

সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে দাখিল করা বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানির ব্যবসায়িক তথ্য পর্যালোচনায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে ১৫টি বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানিতে নতুন পলিসি বিক্রি হয়েছে ১৪ লাখ ৭,৯৭৪টি। অন্যদিকে তামাদি হয়েছে ১১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৩টি পলিসি।

এ প্রসঙ্গে বীমা বিশেষজ্ঞ মামুন রশীদ বলেন, পলিসি তামাদি হলে কোম্পানির সাময়িক আর্থিক লাভ হয়। কিন্তু দেশে তামাদি পলিসি যে হারে বাড়ছে, তা জীবন বীমা খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বীমা খাতে বড় ধরনের ধস নেমে আসতে পারে।

আইডিআরএর সদস্য সুলতান উল আবেদীন মোল্লা বলেন, অন্যান্য দেশে তামাদি পলিসির হার ২০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও আমাদের দেশে ঘটছে তার উল্টোটি।

কোনো কোনো কোম্পানিতে মোট পলিসির ৮০ শতাংশই তামাদি, যা খাতটির জন্য ক্ষতিকর। এতে কোম্পানির তহবিলের পরিমাণ কমে আসবে এবং কোম্পানি এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে।

তামাদির হার বৃদ্ধির পেছনে বীমা প্রতিনিধিদের দুর্বলতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, আমাদের অধিকাংশ বীমা প্রতিনিধি অদক্ষ ও অশিক্ষিত। তবে শিগগিরই বীমা প্রতিনিধিদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেবে আইডিআরএ।

কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সালে চারটি কোম্পানির পলিসি তামাদি হয়েছে আশঙ্কাজনক হারে।

এ চার কোম্পানির তামাদি পলিসির সংখ্যা নতুন বিক্রি করা পলিসির চেয়ে বেশি। কোম্পানিগুলো হলো— প্রগতি লাইফ, সানলাইফ, পপুলার লাইফ ও প্রগ্রেসিভ লাইফ।

তামাদির সংখ্যা বেশি হওয়া কোম্পানির শীর্ষে আছে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স।

কোম্পানিটি ২০১৩ সালে নতুন পলিসি বিক্রি করেছে ৩০,৩৭০টি। একই বছর তাদের পলিসি তামাদি হয়েছে ১ লাখ ১৪,৫৩০টি।

এর পরের অবস্থানে আছে পপুলার লাইফ। কোম্পানিটি এ বছর পলিসি বিক্রি করেছে ২ লাখ ৭,৮৮০টি। একই বছর ওই কোম্পানিতে পলিসি তামাদি হয়েছে ২ লাখ ৩৫,১৭৮টি।

এছাড়া প্রগ্রেসিভ লাইফ বিক্রি করেছে ২৩,০৬২টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৩৯,৪৫৭টি। আর সানলাইফ বিক্রি করেছে ৪১,০৫৬টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৫৬,৬৩১টি।

এ প্রসঙ্গে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জালালুল আজিম বলেন, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা দুর্বল ছিল। মূলত ওই সময়ই কোম্পানির তামাদির হার বাড়তে শুরু করে। তবে বর্তমানে তা আবার কমতে শুরু করেছে।

বাকি ১০টি কোম্পানির তামাদি পলিসির পরিমাণ বিক্রীত পলিসির  প্রায় সমান বা কম। এর মধ্যে পদ্মা ইসলামী লাইফ বিক্রি করেছে ৪১,৩৪৯টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৪০,০৭৬টি।

ন্যাশনাল লাইফ বিক্রি করেছে ২ লাখ ২২,৯৩৭টি, তামাদি হয়েছে ১ লাখ ১২,৮৪৯টি। প্রাইম ইসলামী লাইফ বিক্রি করেছে ৫৫,০৬৮টি, তামাদি হয়েছে ৩৮,৩৫৯টি।

মেঘনা লাইফ বিক্রি করেছে ১ লাখ ৪৫,৬৮২টি, তামাদি হয়েছে ১ লাখ ২১,১৭৭টি। হোমল্যান্ড লাইফ বিক্রি করেছে ২৪,৩৯৮টি, তামাদি হয়েছে ১৭,০৩৪টি।

রূপালী লাইফ বিক্রি করেছে ৪৪,৫৪৫টি, তামাদি হয়েছে ৫,৪৭০টি। ডেল্টা লাইফ বিক্রি করেছে ১ লাখ ৮৫,৪২৬টি, তামাদি হয়েছে ১ লাখ ৭,১৬৮টি।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ বিক্রি করেছে ১ লাখ ২৬,৪৯৫টি, তামাদি হয়েছে ১ লাখ ২৫,০৭৪টি। মেটলাইফ অ্যালিকো বিক্রি করেছে ১ লাখ ৫৭,৪৩৬টি, তামাদি হয়েছে ৩২,১২৩টি।

সানফ্লাওয়ার লাইফ বিক্রি করেছে ৩৩,৬৫৫টি, তামাদি হয়েছে ২০,২৩৮টি।

বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী নতুন পলিসি বিক্রি করে কোম্পানি যে অর্থ পায়, তার ৯০ শতাংশই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে খরচ করা হয়। বীমা আইনেই এ সীমা বেধে দেয়া হয়েছে।

অর্থাৎ নতুন বীমা পলিসি বিক্রির মাধ্যমে যে আয় হয়, তার ১০ শতাংশ কোম্পানির তহবিলে জমা হয়। এর পর পলিসি তামাদি হয়ে গেলে গ্রাহককে আর কোনো অর্থ ফেরত দিতে হয় না।

ফলে কোম্পানির তহবিলে জমা হওয়া প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ১০ শতাংশই কোম্পানির মুনাফায় পরিণত হয়।

পলিসি তামাদি হওয়ার ফলে এমন লাভের সম্ভাবনা থাকায় কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের (এজেন্ট) ওপর পলিসি নবায়ন করতে তেমন চাপ প্রয়োগ করেন না।

অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী, বীমা পলিসি বিক্রি ও প্রিমিয়ামের অর্থ আদায়ের দায়িত্বে থাকা এজেন্টরা প্রথম বর্ষে আদায় করা প্রিমিয়ামের ওপর ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পায়।

আর নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে এজেন্টরা দুই বছর কমিশন পান। এর মধ্যে নবায়নের প্রথম বছরে  (পলিসির দ্বিতীয় বছর) সর্বোচ্চ কমিশন প্রিমিয়াম আয়ের ওপর ১০ ও পরের বছরে ৫ শতাংশ।

তবে এর পরের বছরগুলো অর্থাৎ তিন বছর পর এজেন্ট কোনো কমিশন পান না। ফলে নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ে এজেন্টের কোনো আগ্রহ থাকে না।

জানা গেছে, পলিসি তামাদি হওয়ার পর গ্রাহকের পাঁচ বছর পর্যন্ত পলিসিটি সচল করার সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে গ্রাহককে বকেয়া প্রিমিয়ামের অর্থসহ এক নির্দিষ্ট হারে জরিমানা দিতে হয়।

সাধারণত এ জরিমানার হার ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে থাকে। তবে পলিসি তামাদি হওয়ার পর জরিমানা দিয়ে সচল করার হার খুবই সীমিত।

সম্পাদনায় / জীবন

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top