সকল মেনু

১২ বছর পর চোঁখের দৃষ্টি ফিরে পেলো দুই বৃদ্ধ

 এম. শরীফ হোসাইন, চরফ্যাশন ঘুরে এসে: ভোলার চরফ্যাশনের রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা পল্লী চিকিৎসক সামসুদ্দিন (৬৭)। গ্রামের অন্যের চিকিৎসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। ওই টাকা দিয়েই পরিবারের ১০ সদস্যের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতেন। কিন্তু এক বিপর্যয় তার অভাবী সংসার হানা দেয় অভাবের তান্ডব। ১২ আগে একটি পোকার আক্রমনে তার চোঁখে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। অন্ধ চোঁখ দিয়ে কাউকে দেখতে পেতেন না। চিকিৎসার জন্য চরফ্যাশন, বরিশাল ও ঢাকা গিয়ে অর্থ ব্যায় করলেও কোন চিকিৎসক তার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। ভেবেছিলেন আর চোঁখে দেখতে পারবেন না। পরে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পেরে চরফ্যাশনের গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চোখের চিকিৎসা গ্রহণ করে অপারেশনের মাধ্যমে শেষ বয়সে পৃথিবীর আলো দেখতে পেলেন সামসুদ্দিন। চর মাদ্রাজ ইউনিয়নের চর নাজিম উদ্দিন গ্রামের দরিদ্র কৃষক সুলতান (৮৫)। ১৫ বছর আগে বার্ধক্যজনিত কারণে চোঁখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু বিভিন্ন চিকিৎসকের সরনাপন্ন হয়েও চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে পারেনি কেউ। তিনিও গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন। শুধু সামসুদ্দিন ও সুলতান নয়, তাদের মত হাজারো মানুষ কম খরচে চিকিৎসা গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। প্রত্যান্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে ভোলার চরফ্যাশনের দক্ষিণ আইচায় চলছে চিকিৎসা সেবা ও অপারেশন ক্যাম্প। এ ক্যাম্পেই এখন হাজারো মানুষের ভীড়। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো নারী-পুরুষ ও শিশু কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ চিকিৎসা গ্রহন করে সুস্থ্য জীবনের স্বপ্ন দেখছেন। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে চরফ্যাশন উপজেলার গনস্বাস্থ্য হাসপাতাল এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গর্ভকালীন মা, শিশুদের নিউমোনিয়া, ছোট-বড় কাটা ছেড়া, স্বর-সর্দি, আমাশয়, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ও প্যাথলজি সেবা দেয়া হয়। এতে খরচ বহন করতে হয় খুবই নগন্য। তবে এসব মানুষকে আগে দুরে দুরান্ত গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়েছে। কিন্তু এখন হাত নাগালেই চলে এসেছে উন্নত চিকিৎসা সেবা। গনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এ সেবাকে আরো প্রসারিত করার লক্ষ্যে নতুন করে ৯দিন ব্যাপী চিকিৎসা ক্যাম্প স্থপান করেছে। গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল সুত্র বলছে, গনস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকগন এ সেবা পরিচালনা করছে। গত ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়ায় এ ক্যাম্প চলবে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রথম দিন থেকেই চরফ্যাশন উপজেলার রসুলপুর ও চর মানিকা ইউনিয়নের বাসিন্দাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ এ ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করছে। ৯দিনে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৬শ’ ৯২ জন রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ১শ’ ২৫ জন রোগী জেনারেল সার্জারী ও গাইনী অপারেশনের সুযোগ পেয়েছেন। যারমধ্যে ২টি অষ্টোওমাইলাইটিস, একটি রেকটাল পলিপ, একটি এনালফিসার, ৩৪টি হার্নিয়া, একটি সিরাজ, একটি টোটাল এবডুমিনাল, ৪টি ভ্যাজাইনাল হিস্টেকমি, একটি ফ্রাইবয়েড, ৬টি ডিএনএস, ২টি কলিসিস্টেকটমি, একটি টনসাইটিস, একটি গ্রেনুলোমা সিস্ট, ২টি ল্যাপারেটমী, ২টি হেমোরয়েডসহ ৫৯টি বড় ও মাঝারী অপারেশন এবং ৬৬টি অনান্য অপারেশন। এছাড়াও ৪১ ব্যক্তির চোখের ছানি কেটে নতুন লেন্স বসিয়ে দৃষ্টি শক্তি পূনরুদ্ধার করা হয়েছে, ৭ জনের ডিসিটি, ১ জনের ক্যালাজিওন ও ২ জনের টেরিজিয়াম অপারেশন করা হয়েছে। ঢাকার গনস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের ১৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৩ জন ফিজিওথেরাপিস্ট, ১ জন ফার্মাসিস্ট, ২ জন মাইক্রোবায়োলজিষ্ট, ২ জন প্যাথলজি টেকনেশিয়ান এবং ৮জন নবীন চিকিৎসক ও ২১ জন প্যারামেডিক এর সমন্বয়ে মোট ৫১ জন চিকিৎসক দল রোগীদের পরামর্শ ও চিকিৎসা দিচ্ছেন। ক্যাম্প ছাড়াও অন্যদিনগুলোতে প্রতিনিদিন গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সার্বক্ষনিক ২ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসব চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চোখের সেবা নেয়া রোগী সামসুদ্দিন বলেন, ১২ বছর ধরে অন্ধ ছিলাম। ছেলে-মেয়ে ও আত্মী-য়স্বজনসহ কোন মানুষকেই দেখতে পারিনি। ভেবেছিলাম কোন দিনও চোখে দেখতে পারবো না। কিন্তু গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চোখের চিকিৎসা করিয়ে অপারেশনের মাধ্যমে চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছি। পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়ে খুব আনন্দ লাগছে।
রোগী আব্দুল মোতালেব ও সাহাবুদ্দিন জানান, আগে চিকিৎসা নিতে অনেক দুরে যেতে হতো চিকিৎসা-ব্যবস্থাপত্র ও পরীক্ষা-নিরিক্ষা করতে বাড়তি অর্থ ব্যায় হতো। কিন্তু নিজ এলাকায় গনস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে খুব অল্প খরচে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছি।গনস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: ইকবাল হোসেন বলেন, গত বছর আমরা চিকিৎসার মাধ্যমে একজনের চোখ ভালো করে দিয়েছি। এ বছর দৃষ্টিহীন রোগীর অপারেশন করে চোখ ভালো করে দিয়েছি। চিকিসা গ্রহণ করে উভয়ই এখণ সুস্থ রয়েছে।
গাইনী চিকিৎসক ডা: নিশা আক্তার বলেন, আমরা লোকাল এরিয়াতে কাজ করছি, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গ্রামে এসে ডাক্তাররা কাজ করতে চায়না। কিন্তু এটাই আমাদের প্রধান ব্যাপার যে আমরা চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য রুট লেভেলে এসে কাজ করছি। রোগীদের সেবা প্রদান করছি। তবে চরফ্যাশনে অনেক স্থানেই রোগীকে উপজেলা সদর কিংবা জেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা করতে হচ্ছে। তবে বেশী জুরুরী রোগীদেরকে আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রেফার করে দিচ্ছি। আমরা আন্তরিকভাবে রোগীদের সেবাদানে কাজ করছি।
গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা নামক এলাকায় সড়কের পাশে গনস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়। ৩০ বেডের হাসপাতালে প্রতিদিন ৬০/৬৫ জন রোগী চিকিৎসা নেন। বিভিন্ন কারণে ভর্তি হন ৮/১০জন। এর আগে ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দেয়। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর, মহাসেনসহ বিভিন্ন দুর্যোগের সময় মেডিকেল টিম গঠন করে চিকিৎসকগন বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষুধ বিতরন করে আসছে।
গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা: রেজাউল হক বলেন, প্রথম অবস্থায় রসুলপুর ও মানিকা ইউনিয়নের ৭২ হাজার মানুষ এ চিকিৎসা সেবার আওতায় রয়েছে। শুরু থেকে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হতো। এখন দুটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে ব্যবস্থা পত্র হিসাবে সামান্য ফি ও পরীক্ণা-নিরিক্ষার জন্য অল্প মূল্য নেয়া হচ্ছে। তবে তা খুবই নগন্য। প্রত্যান্ত এলাকায় দরিদ্র জনগোষ্টির মাথে সেবা পৌছে দেয়ার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে জেলার ১০ লাখ মানুষকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনা হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top