সকল মেনু

রক্ত !প্রিন্স আশরাফ

 কুষ্টিয়া সদর মডেল (?) থানার এসআই ওবায়েদ বেশ বন্ধুবৎসল। নিঃসন্তান মানুষেরা একটু বন্ধুবৎসল বেশি হয়। সে কারণে ওবায়েদ বন্ধুর সাথে বাজি ধরে বসল। বাজি না ধরলে বন্ধুত্ব কখনও গাঢ় হয়? সন্ধ্যার পরে চেম্বার শেষে ডাক্তার বন্ধু আশফাক এসেছিল থানায়; আড্ডা দিতে। আশরাফের স্ত্রী-কন্যা আম-কাঁঠালের ভোগে বাবার বাড়িতে। সময় কাটাতেই আসা। কথাপ্রসঙ্গে দুই বন্ধু ঠাণ্ডা পান করতে করতে তর্ক জুড়ে দিল- ‘সমাজের জন্য কার অবদান সবচেয়ে বেশি?’
ডাক্তার নিজের কোলেই ঝোলা টানলেন- ‘মানুষের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তোলাই ডাক্তারের কাজ।’
‘আর পুলিশের? সমাজের ক্ষতগুলোকে ঢেকে সমাজটাকে সুন্দর রাখা।’

বন্ধুদের তর্ক অমনই। কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। শেষমেষ বাজি। পুলিশ জানায়, হোটেলে কচি মাল এসেছে, ওর থেকে ইচ্ছে করলে ডাক্তার একটা বেছে নিতে পারবে।
ডাক্তার জানায়, ঠিক আছে। সেও তার হাসপাতালের যৌবনাবতি সুন্দরী নার্সকে ওর সেবায় ব্যবস্থা করে দেবে।
কারা যে সমাজের জন্য সবচেয়ে উপকারী তা প্রমাণের জন্য ডাক্তার একদিন চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ রেখে হাসপাতালে ডিউটি দেবে।
আর পুলিশ?
এসআই ওবায়েদ নিজেই বলল, ‘আমি আজ সারারাত ডিউটি দেব। এরকম ডিউটি করব যে রাস্তা দিয়ে একটা কাকপক্ষীও পুলিশের টহল এড়িয়ে যেতে পারবে না।’
ওবায়েদ ডাক্তারকে তার সাথে টহল গাড়িতে থাকার অনুরোধ জানালেও ডাক্তার বলল, ‘তোর ভাবী মিতু বাসায় নেই বলে আজ নাইট ডিউটি নিয়েছি।’
ওবায়েদ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বিড়বিড় করে নিজের মনে বলল, ‘আর তোর ভাবী বাসায় থাকলেও যেতে ইচ্ছে করে না। তাই নাইট ডিউটি নিয়েছি। কারণটাও তুই জানিস।’

পুলিশ রাতের টহলে বেরিয়ে পড়ার আগেই শহরতলীর ওয়াসিম শ্বাশুড়ির কাছ থেকে মোবাইল ফোনে সুখবরটি শুনেছে। প্রথম সন্তান; পুত্র। সন্ধ্যেয় ওয়াসিমের স্ত্রী রোকেয়ার প্রসব বেদনা ওঠে। এক্সপেকটিং ডেট আগেই জানিয়েছিল ডাক্তার। সেই মতো প্রস্তুত ছিল প্রথম সন্তান জন্ম দিয়ে রাজ্য জয় করতে যাওয়া দম্পত্তি। জল ভাঙতে শুরু করার আগেই স্ত্রীকে ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিন রিকশায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে আনতে পেরেছে ওয়াসিম।
হাসপাতালের গাইনী ডাক্তার তরুণ কান্তি ঘোষ দেখে সিজারিয়ান অপারেশন করা লাগতে পারে জানিয়ে সেই মতো ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেন। শুধু উপার্জনক্ষমই নয়, দুই পরিবারের কার্যক্ষম পুরুষ বলতে ওয়াসিম একাই। তার কোনো ভাই বোন নেই। স্ত্রীর মা, বোন এলেও তারা শুধু হাসপাতালে বসে মেয়েলী দিকটা সামলাতে পারে। কিন্তু দৌড়াদৌড়ির কাজ সব ওয়াসিমকে একাই করতে হচ্ছে। টাকার জোগাড় করে রাখলেও সময়মতো টাকাতেও সবকিছু মেলে না। তাই তো রাত দশটা নাগাদ ওষুধপত্রের জোগাড় করে ওয়াসিম বাড়িতে গিয়েছিল সারাদিনের খাটাখাটুনির পরে একটু বিশ্রাম নিতে। কিন্তু পুরুষ মানুষের কবরে শোয়ার আগে কোনো বিশ্রাম নেই।

মাঝরাতে সু-খবর আসে। পুত্র সন্তানের গর্বিত পিতা ওয়াসিম। কিন্তু সব ভালোর আড়ালের খারাপের মতো সে জানতে পারে স্ত্রীর অবস্থা ভালো নয়। দ্রুত রক্ত প্রয়োজন; বি-পজেটিভ। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে নেই। তবে বেসরকারি কয়েকটা ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিলে পাওয়া যেতে পারে।
ওয়াসিম দিশেহারা হয়ে পড়ে। আগে হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। বাসা থেকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে ওয়াসিম। কিন্তু সেই রাতে জেলখানা মোড়ে পৌঁছলে টহল পুলিশের গাড়ি ওর গতিরোধ করে। তারা ওকে ‘মক্কেল’ সাব্যস্ত করে বলে, ‘রাত একটায় জেলখানা রোডে কি? তোর তো জেলখানার ভেতরে থাকার কথা? বাইরে কেন?’
‘স্যার। আমার একটা বাচ্চা…মানে আমার বউয়ের বাচ্চা হয়েছে। ছেলে। জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু বউডার অবস্থা স্যার খুব একটা ভালো না। রক্ত লাগবে। অনেক রক্ত। সেই রক্তের জোগাড়ে যাচ্ছি স্যার।’

রক্ত! খুন! এসআই ওয়াবেদ চমকে ওঠেন! ব্যাটার দিকে আবার তাকান। চেহারা তো চোরের মতো। না না, খুনির মতো। নিশ্চয় এই মাঝ রাতে কাউকে খুন করতে যাচ্ছে হারামজাদা!
‘ওঠ হারামজাদা! গাড়িতে ওঠ!’ গাড়ি মানে পিকআপ ভ্যান।
‘স্যার, একটু দয়া করেন। না হলে আমার বউডা মরে যাবে স্যার। আমার বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না স্যার। ওকে একবার চোখের দেখাডাও এখনও দেখিনি স্যার!’ ওয়াসিম যেভাবে কাকুতি মিনতি করতে থাকে তাতে পুলিশের উর্দি পরা না থাকলে ওবায়েদের হৃদয় এতক্ষণ গলে দ্রবীভূত হতো। কিন্তু পুলিশের উর্দি ভেদ করে ওয়াসিমের মিনতি হৃদয়ে পৌঁছায় না। বরং সন্তানের কথা শুনে যেন ওবায়েদের মাথায় আগুন ধরে যায়। দীর্ঘ এগারো বছর বৈবাহিক জীবনে সে সন্তানের মুখ দেখতে পেল না। স্বামী-স্ত্রী দুজনই স্পেশালিষ্ট ডাক্তার দেখিয়েছি। কারোর কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা শুধু গর্ভধারণ না করা। ডাক্তার-কবিরাজ, পীরফকির, হোমিপ্যাথি, এলোপ্যাথি- যে যা বলেছে, তাই করেছে, একটা সন্তানের আশায় দুজনে মিলে দড়িখুটো বাদ দিয়ে যে যা বলেছে তাই খেয়েছে। একজনের কথা শুনে অখাদ্য কুখাদ্যও খেয়েছে। কিছু কিছু হয়নি। স্ত্রীর পেট ফোলেনি। শুধু চর্বি জমে গোলগাল শরীর হয়েছে। আর এইসব হাড় হা-ভাতে চাষাভুষা ফকির মিসকিনের দল। মন চাইলে পেটে বাচ্চা ঢুকিয়ে দিতে পারে। মন চাইলেই বাচ্চা বিয়োতে পারে। ইচ্ছে করলে বছর বছর একটা করে পয়দা করতে পারে। আল্লা ওদের অন্যদিকে সম্পদশালী না করলেও বীর্যে বীর্যবান করে রেখেছেন। আজ পর্যন্ত কোনো আটকুড়ে রিকশাওয়ালা তার নজরে পড়েনি।

এসআই ওয়াবেদ গর্জে উঠল, ‘ওসব ধানাইপানাই কথা বহুত শুনেছি। ও ধারাপাত পুলিশের পড়া আছে। আকাম কুকাম করতে যেয়ে রাত বিরাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কি কথা বলতে হয় তা আমাদের শেখা আছে। তুই ব্যাটা, ওই স্কুলের ছাত্র হলে আমরা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।’
‘স্যার, আপনার দুটি পায়ে পড়ি স্যার। আমাকে আটকে রাখবেন না স্যার। এক একটা মুহূর্ত আমার বউয়ের জন্য, বাচ্চার জন্য আজরাইলের নেমন্তন্ন করার শামিল স্যার। একটু দয়া করেন স্যার, আমারে একটু যেতে দেন স্যার।’
‘তোর বউ যে হাসপাতালে, বাচ্চা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ তোর কাছে আছে? নেই? তাহলে? এই মাঝরাতে তোরে ছাড়ি ক্যামনে? পুলিশের ডিউটি বলে কথা আছে না। আমাদের বদনাম হতে হতে এরকম হয়েছে এখন সন্ত্রাসী ধরলেও বদনাম হয়।’
‘না স্যার, আমি সন্ত্রাসী না স্যার। মাছ ব্যবসায়ী। এর পুকুর, ওর খাল থেকে মাছ কিনে এনে বাজারে বিক্রি করি স্যার। আপনি একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন স্যার।’কথা বলতে বলতে ওয়াসিমের চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নামে।

ওবায়েদ ওসব ভ্রুক্ষেপ করে না। ‘ঠিক আছে, তুই রাতটা পিকআপে থাক। সকালে খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় কি মাছ বেচিস তুই?’
‘স্যার, তাহলে ওরা কেউ বাচতো না স্যার। আজ রাতটাই কালরাত স্যার। যেভাবে হোক স্যার আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।’
‘যেভাবে হোক! আমি ছেড়ে না দিলে তুই যাবি কি করে? মারামারি করবি? পুলিশের সাথে? তোর কথাবার্তা অসংলগ্ন। সন্দেহজনক ঘোরাফেরা। তোকে ফিফটিফোরে এ্যারেস্ট করা হলো। দেখি তোর কোন বাপে ছাড়ায়! এ্যাই, এই বদমাশটারে পিকআপে তোল!’
‘স্যার, কোনদিকে যাব?’- ড্রাইভার জানতে চায়।
‘চল, শহরটাতে একটা চক্কর দিয়ে আসি। রাতবিরাতে গাঞ্জাগুঞ্জা খেয়ে ঘোরা দুচারটেরে গাড়িতে তুলি। সকালে বাছাই করা যাবে।’
‘এরে নিয়েই শহরে ঘুরবেন স্যার?’
‘তো কি ওরে ফাইভ স্টার হোটেলে রেখে আসব? গাধার মতো কথা বলিস!’

ওরা ঘুরতে থাকে। শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা। জেলে পাড়া থেকে মুচিপাড়া। পতিতালয় থেকে দেবালয়। সব রাস্তা উপরাস্তায় চলতে থাকে চক্কর। পিকআপের ভেতরে বসে কাকুকি মিনতি করতে থাকা যুবকের বিলাপ ধ্বনি গহীন রাতের নিস্তব্ধতার মত একঘেয়ে বিজবিজানির আওয়াজে পরিণত হয়। যেন ঘুমপাড়ানি গান। সেই ঘুমপাড়ানি গানে চোখ লেগে আসে এসআই ওবায়েদের। গাড়ির ঝাকুনিতে এক সময় তার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায়। ড্রাইভারকে ধমক দিতে গিয়েও দেয় না, বাইরের দিকে তাকায়। চারিদিকে কেমন একটা আলো ফোটা ভাব। সকাল হয়ে গেল নাকি?

সকাল হয়ে আসছে দেখি। ফজরের আজান পড়ছে?’
‘জি না স্যার, কেবল চারটা বাজে। এখনও ঘণ্টাখানেক রাত আছে।’
‘গাড়ির মধ্যে গুনগুন করে গান গায় কে?’
‘গান গায় না স্যার, কান্দে। ব্যাডার বউ পোলা মরছে না বাচছে আর রক্ত রক্ত কইয়া সুর করে কানতাছে!’
রক্ত শুনেই তড়াক করে সটান হয় শরীর। তখনই মনে পড়ে যায় মাঝরাতে তোলা যুবকের কথা। কোন সন্ত্রাসী, ছন্নছাড়া, ভবঘুরে হলে এরকমভাবে তিন চার ঘণ্টা একটানা কেঁদে আকুল হতো না। নিশ্চয় ঘোর সংসারী মানুষ। সংসারী মানুষ আজীবন কাঁদে। ব্যাপারটা কি দেখতেই হয়!

আয়ুব, যাও তো এরে নিয়ে জেনারেল হাসপাতালে যাবা। ওর কথামতো রোগী আছে কিনা দেখে আমাকে ফোনে জানাবা। আমি এখানে থাকব। যাও, যেতে যেতে আবার রাত কাবার করো না।’
হাসপাতালে এসে ওয়াসিম বলে, ‘এবার আমারে ছেড়ে দেন। দেখলেন তো সব। এখন রক্তের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা দেখি!’
‘খাড়ান, আগে স্যারের লগে কথা কইয়া লই।’আয়ুব মোবাইল বের করে এসআইকে ফোন দেয়, ‘স্যার, ঘটনা সত্য। আমি হাসপাতালে। লন, ডাক্তারের লগে কথা কন।’
‘ডাক্তার লাগবে না। তুমি দেখেছো তাতেই চলবে। ঠিক আছে, ওকে ছেড়ে দাও। আর হাসপাতালে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবা অসংলগ্ন কথা বলছিল বলে এই একটু পুলিশ ভ্যানে তুলে রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছি। ব্যস, আর কোনো কথা নয়। চলে এসো।’

এরপর ওয়াসিম ছোটাছুটি করে রক্তের জোগাড় করে ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে রক্তশূন্যতায় প্রিয়তমা স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। পরদিন ফোন পায় এসআই ওবায়েদ। ডাক্তার বন্ধুর ফোন- ‘তুই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস! পত্রিকায় নাম উঠে গেছে। বাজিতে তো তুই জিতেছিস রে শালা! এখন তো তোর সেবায় সুন্দরী নার্স রেডি রাখতে হয়! বল নার্সের সেবা নিতে কখন আসবি? বাজিতে হেরেই বুঝলাম পুলিশের চেয়ে জনগণের বড় সেবক আর নেই।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top