সকল মেনু

নিরানন্দে ঈদের বাজার

 সাহিত্য ডেস্ক: হোজ্জা দাওয়ায় বসে একমনে কিসের যেন হিসাব করছিল। এমন সময় বন্ধু খসরু এসে উপস্থিত। হোজ্জাকে হিসাবের কাজে ব্যস্ত দেখে সে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, কী এতো হিসাব করছ? বন্ধুর গলা শুনে হোজ্জা মুখ তুলে চাইল। তারপর মুচকি হেসে বলল, দুদিন বাদে ঈদ। ঈদের দিন তো আর মাথা ঠিক থাকবে না। তাই সেদিন কার বাড়ি কখন যাব আগেভাগেই হিসাব করে তালিকায় লিখে রাখছি।  পাঠক, এ আমার শোনা গল্প নয়, পড়া গল্প। ফলে চট করে একে গুলগল্প ভাবতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, ঈদে তালিকা তৈরির এই সংস্কৃতি এখনও বিদ্যমান। গত ঈদেও আমাদের চেরাগ আলীর বাজারে রাতের আঁধারে কে বা কাহারা একটি তালিকা তৈরি করে পাঠিয়েছিল। তালিকায় বাজারের কোন ব্যবসায়ীকে তাদের কত টাকা ঈদ বখশিশ দিতে হবে সবিস্তারে উল্লেখ ছিল। এমনতর তালিকার উদাহরণ আরও দেওয়া যায় বৈকি! তবে তাতে আসল তালিকার কথা চাপা পড়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে তাই আপাতত থাক সে কথা। ঈদের অন্যতম একটি তালিকা হচ্ছে কেনাকাটার তালিকা। এই তালিকা বাড়ির গিন্নি স্বয়ং প্রস্তুত করেন। তালিকায় সেমাই থেকে সূতি শাড়ি, বডি স্প্রে থেকে সুগন্ধী চাল, নেইল পালিশ থেকে বিছানার বালিশ, দরজার নতুন পর্দা থেকে পানের জর্দা কোনো কিছুরই অনুল্লেখ থাকে না। এরপর পুত্রের খাটো পাঞ্জাবীর সাথে দুই ঠ্যাং অথচ চৌদ্দ পকেটের প্যান্ট, কন্যার বলিউডি লেহেঙ্গা, শ্যামল শ্যালিকার জন্য শ্যামলা রঙের জীবনানন্দ বুটিক সেট। শ্বশুড়ের জন্য কড়া ভাজের পাঞ্জাবী, শ্বাশুড়ির জর্জেট-জামদানি উইথ নূরজাহান আতর এসব তো আছেই। তালিকা হাতে পেয়ে বেচারা গৃহকর্তার ত্রাহি অবস্থা! কারণ সর্বংসহা গৃহকর্তা ভালো করেই জানেন এই তালিকা অমান্য হলে গৃহদাহ সুনিশ্চিত। ভেবেছেন গাইগুই করে কোনোমতে পার পেয়ে যাবেন?

ভুল ভেবেছেন। উল্টো আপনার পৌরুষ তখন হবে প্রশ্নের সম্মুখীন। দিন কি রাতে সাঁঝ প্রভাতে গিন্নি তখন আপনার কানের কাছে কলের গানের মত বাজতেই থাকবে :

এ কেমন পুরুষ তুমি
এ কেমন মর্দ,
কেনাকাটার আগেই কাঁদো
দেখে ঈদের ফর্দ।

অতএব পিতৃপ্রদত্ত জীবন এবং বিবেক প্রদত্ত ইজ্জত বাঁচাতে তখন আপনাকে গিন্নির পেছন পেছন ছুটতেই হবে এ মার্কেট থেকে ও মার্কেটে। প্রতিদিন অফিস শেষে এ হলো সস্ত্রীক ওভারটাইম!

ঈদ এলেই বিপণীবিতানগুলোতে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। শহরে এসে লাল লাল, নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা পরাণ জুড়িয়ে নেওয়ার এ হলো মোক্ষম সুযোগ। তবে সাধু সাবধান! গিন্নিকে নিয়ে এই লাল নীল বাতি দেখতে এসে কত গৃহকর্তার পকেটে যে ‘লালবাত্তি’ জ্বলেছে সে কেবল ইতিহাস সাক্ষী। পতঙ্গ উড়ে এসে যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয় গৃহকর্তার জন্য এ অনেকটা সেরকমই। এ জন্য প্রলোভনেরও কমতি নেই। সব বিপণীবিতানেই চলছে ছাড়ের ছড়াছড়ি। এটা কিনলে ওটা ফ্রি তো আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে ঈদের বিশেষ ডিসকাউন্ট অফার।

কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম, ঈদের সময় দোকানীরা ১০% বা ২০% ছাড় দেয় কেন?
উত্তর হলো, তারপরও দোকানীর ৫০% লাভ থাকে বলে।
মার্কেট থেকে কেনাকাটা সেরে কচুকাটা হয়ে বের হয়ে আসবেন তারপরও এই ‘ছাড়’ আপনার পিছু ছাড়বে না। মার্কেটের সামনে বছরজুড়ে ‘দ’ হয়ে বসে থাকে যে দাড়োয়ান সে আপনাকে দেখেই লম্বা সালাম ঠুকে বলবে, স্যার। অর্থাৎ বখশিশ!

ওদিকে পকেটের অবস্থা তখন গড়ের মাঠ! তালিকায় তখনও অর্ধেক কেনাকাটা বাকি। এজন্য গিন্নির তারা তো রয়েছেই। রাত হলে গাউছিয়া গিয়ে কোনটা জর্জেট কোনটা মশারি বোঝা যাবে না। দিনের আলো থাকতে থাকতেই ওদিকটা সেরে ফেলতে হবে- এই হয়েছে আরেক যন্ত্রণা! ডাক্তারদের মতো বিপণীবিতানগুলোরও ক্লাসিফিকেশন তৈরি হয়ে গেছে। চোখ, কান, গলা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যেমন লিভারের চিকিৎসা হবে না তেমনি বসুন্ধরা সিটিতে যা মিলবে মাথা ঠুকেও তা বঙ্গবাজারে মিলবে না। এলিফ্যান্ট রোডের কথা না হয় বাদই দিলাম। যদিও এই ঈদে গিন্নিরও চাই নতুন জুতো। অতএব ব্যাগ, বাক্স, থলে হাতে আপনাকে লাটিমের মতো ঘুরতেই হবে এ গলি থেকে ও গলি পথে। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় শরীর ঘেমে উঠবে, মানুষের ভিড়ে বুকের পাজর চিরেচ্যাপ্টা হবে তবুও গিন্নির শপিং শেষ হবে না। তখন মার্কেটের সামনে সুদৃশ্য ফোয়ারা দেখে কোনো গৃহকর্তার মনে হতেই পারে, ইস্! তালিকায় যদি একটা কলসি আর এক গাছা দড়ির কথা লেখা থাকত তবে গলায় কলসি বেঁধে ঐ ফোয়ারায়…।

এ থেকে গৃহকর্তাদের কী কোনো পরিত্রাণ নেই? উপায় আছে জনাব। নিচের এই টিপসগুলো টিপে টিপে পড়ুন।
টিপস এক : ডাকপিয়নের হাতে কিছু গুজে দিয়ে দেউলিয়া হয়েছেন এ মর্মে উকিল নোটিশ পাওয়ার ভুয়া অভিনয় করুন। আপনার এই অভিনয় বাড়িতে মেগাসিরিয়ালের মতো প্রচার করতে থাকুন।
টিপস দুই : এসেছে রমজান। এই সুযোগে ধর্মে-কর্মে মন দিন। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে গোটা কয়েক কম্বল বগলে চেপে সোজা তাবলিগে চলে যান।
টিপস তিন : পরিকল্পনা করে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান। বাথরুমে ‘উই মা’ বলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলেই চলবে। পারিবারিক ডাক্তারকে বলে রাখুন তিনি যেন আপনাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকার পরামর্শ দেন।
টিপস চার : কিছুদিনের জন্য পাগল হয়ে যান। গিন্নির হাতে তালিকা দেখলেই তার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলুন, আম্মা এইডা কী? তুমি প্লেনের টিকেট কই পাইলা?

এতেও যদি কাজ না হয়, তবে এ হলো বুস্টার টিপস। বিফলে মূল্য ফেরত। কৌশলটা হলো আপনি নিজেই একটি তালিকা তৈরি করতে থাকুন। ঝানু রাজনীতিকের মতো পরিবারে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিন। ‘এটা দেব’, ‘ওটা দেব’ বলে সবাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভুং ভাং করে কোনোমতে দেখুন তো ঈদের এ কয়টা দিন পার করতে পারেন কি না। করতে পারলেই কিন্তু কেল্লাফতে!

গৃহকর্তাদের প্রতি শুভকামনা রইল। এর ওপর আবার মোটা-তাজা গরু কেনার ব্যাপার আছে। থাক, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে আলাদা করে আর তাদের চাপে ফেলতে চাই না। মনের কষ্ট হৃৎমাঝারে চেপে প্রাণ খুলে ‘হা হা হা হা’ করতে থাকুন, এক সময় নিজেকে ওই ‘হাম্বার’ মতোই মনে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top