সকল মেনু

সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল

  সংসদ প্রতিবেদক : বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের  প্রস্তাব সংসদে উঠেছে। রোববার দশম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের পঞ্চম দিনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ উত্থাপনের জন্য স্পিকারের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। পরে স্পিকারের অনুমতিক্রমে তিনি বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। বিল উত্থাপনের পর আইনমন্ত্রী তা পরীক্ষাপূর্বক রিপোর্ট প্রদানের জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব করেন। এছাড়া এক সপ্তাহের মধ্যে স্থায়ী কমিটিকে রিপোর্ট প্রদানের জন্য আবেদন করেন আইনমন্ত্রী। চলমান সংসদ অধিবেশনেই বিলটি পাস হবে বলে এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ বিল পাস হলে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরে আসবে, যা ১৯৭২-এর সংবিধানে ছিল। পরবর্তীতে সামরিক শাসনামলে বিলটি রহিত করা হয়। গত ১৮ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিল মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় এবং বিলটি চলতি অধিবেশনেই পাস করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানান আইন মন্ত্রী আনিসুল হক। বিলটি উত্থাপনের সময় আইনমন্ত্রী এর উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যাখ্যা করেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধণের কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিলটিতে বলা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগের কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।

এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্টিত রাষ্ট্রপতিকে সংসদ কর্তৃক অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৫২), সংসদের সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ (অনুচ্ছেদ ৫৭), সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমে স্পিকারকে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৭৪) এবং সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদেরকে অপসারণের বিধান (অনুচ্ছেদ ৯৬) ছিল।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে, যথাক্রমে অভিশংসন, পদত্যাগ ও অপসারণ সম্পর্কিত পূর্ববর্তী বিধান এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলেও সামরিক শাসকের মাধ্যমে অসাংবিধানিক পন্থায় সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পরিবর্তনক্রমে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দুইজন প্রবীন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রীম জুডিসিয়াল কউন্সিলের উপর ন্যস্ত করা হয়, যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠিত সংসদে রাষ্ট্রেল অন্যান্য অঙ্গের মতো উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহিতার নীতি বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদেরকে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনা পুনর্বহালের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন ২০১৪ এর উত্থাপন করা হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধির পাশাপাশি জনপ্রতিনিধির নিকট তার জবাবদিহিতা থাকা সংক্রান্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত থাকবে।

বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যা আছে :

৯৬। (১) এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন বিচারক সাতষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।

(২) এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোন বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।

(৩) একটি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘‘কাউন্সিল’’ বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাঁহাদের লইয়া গঠিত হইবে।

তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোন সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোন বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসমর্থ্য হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাঁহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন।

(৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবে-
(ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা; এবং
(খ) কোন বিচারকের অথবা কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাঁহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোন পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা।

(৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোন বিচারক-
(ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা
(খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

(৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রির্পোট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।

(৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারী ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।

(৮) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পর অনুচ্ছেদ ৯৬’ এ যা প্রতিস্থিত হবে :

৯৬। বিচারকের পদের মেয়াদ: (১) এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে কোন বিচারক সাতষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।

(২) প্রমাণিত অসদাচারণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।

(৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের আসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিবেন।

(৪) কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।

১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদকে বদল করে ১৯৭৪ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি  জিয়াউর রহমান সংসদের কাছ  থেকে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত করেছিলেন। আজ এই বিলটি সংসদে পেশ হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত ১৯৭২ সালের সংবিধানিক সেই অনুচ্ছেদের পুনরাস্থপন হলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top