সকল মেনু

সাংবাদিকতায় কাজী নজরুল ইসলাম

 সাহিত্য ডেস্ক: কি কবিতায় কি গানে, নজরুল যেমন তাঁর মনোভাব অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করতে ভয় পাননি, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও  তেমনি তিনি জনতার কাতারে থেকেছেন। অধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে তিনি স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেছেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ বিদেশি শাসকের কারাগারে তাঁকে কারাভোগ করতে হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও নজরুল শাসকশ্রেণির সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি। তাঁর সাংবাদিক জীবন অবিচ্ছিন্ন, অনমনীয় ও আপোষহীন সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলা ভাষায় বাঙালী-পরিচালিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’ (প্রথম প্রকাশ :  ১৮৩৯-এর ১৪ জুন)। সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। এই পত্রিকাটি তদানিন্তন রাজনৈতিক চেতনা প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন  উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে সাহিত্য, শিক্ষা ইত্যাদি পুনর্গঠনে  ভূমিকা রেখেছে। এরপর  হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ এবং দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ ’(১৫ নভেম্বর, ১৮৫৮)। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সন্ত্রাসবাদীদের মুখপত্ররূপে ‘সাপ্তাহিক যুগান্তর’ আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। রাজদ্রোহিতার অভিযোগে ভূপেন্দ্রনাথ ও ব্রহ্মবান্ধবকে অভিযুক্ত করা হয়। ব্রহ্মবান্ধব বিদেশি শাসকের বিচারে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন এবং কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ‘বসুমতি’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এরপর নজরুল সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক দুঃসাহসিক অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ এবং ‘ধূমকেতু’ এক যুগান্তরের জন্ম দেয়।

আবুল কাশেম ফজলুল হক (শের-এ-বাংলা, যিনি পরে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন, এটি ছিল সান্ধ্য দৈনিক। ফজলুল হক নিজেই সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও মোজাফ্ফর আহমদ। নবযুগ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। ছোট ছাপাখানায় যে সংখ্যক পত্রিকা প্রকাশ হতো তা ছিল পাঠকের চাহিদার তুলনায় কম। নজরুলের ক্ষুরধার লেখনিতে পত্রিকাটি জনপ্রিয়তা পায় ঠিকই তবে শাসক ব্রিটিশদের জন্য তা ভয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। এ সময়ই নজরুলের মধ্যে কবি ও স্বাধীনতার সৈনিক এই দুই সত্তার আশ্চর্য ও দুর্লভ মিলন ঘটে।

কাজী নজরুল ইসলাম সংবাদ-এর হেডিং দিতে পারতেন চমৎকার। ছোট কাগজে স্থান সংকুলান হয় না, তাই তিনি দক্ষতার সঙ্গে খবরকে অল্প কথায় পাঠকের বোধগম্য করে ছাপতেন। এ সময়ই নজরুলের কয়েকটি কবিতা প্রকাশ হয় এবং কবি খ্যাতি সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সাংবাদিক প্রতিভাও জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়। নবযুগে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে রাজনৈতিক লেখা শুরু হয়। কৃষক-মজুরদের দাবির কথাও লেখা হয়। এর ফলে পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়ে এবং জামানতের এক হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন তাঁরা দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে আবার পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই সময় কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে এ কে ফজলুল হকের সাথে নজরুলের মতভেদ হয় এবং তিনি কাজে ইস্তফা দেন। কিছু দিন পর কমরেড মোজাফ্ফর আহমদও কাজ ছাড়লে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। নবযুগে সম্পাদকীয় স্তম্ভে তিনি যে বহ্নিদীপ্ত আবেগোচ্ছ্বসিত প্রবন্ধ লিখতেন তা ‘যুগবাণী’ শীর্ষক প্রবন্ধ পুস্তকে প্রকাশ করেন (১৯২২ খ্রিস্টাব্দ)। রাজদ্রোহের অভিযোগে বইটি  ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

নবযুগের হেডিং তৈরি করে নজরুল তাঁর কাব্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন: রবীন্দ্রনাথের কবিতার পঙ্‌ক্তি থেকে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণসখা বন্ধু হে আমার’ এবং ‘কালাতে ধলাতে এবার লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/ দেখি নাই কভু দেখি নাই ওগো, এমন ডিনার খাওয়া।

কৃষক-মজুর প্রভৃতি উপেক্ষিত জনসমাজের প্রতি নজরুলের যে অসাধারণ মমত্ববোধ ও তাদের শক্তির উপর তার যে গভীর ও অবিচল আস্থা ছিল, তার পরিচয় নবযুগে প্রকাশিত ‘ধর্মঘট’, ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ প্রভৃতি প্রবন্ধে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে নবযুগ আবার প্রকাশিত হয়। এবার সম্পাদক নিযুক্ত হন কাজী নজরুল ইসলাম। ধুমধামের সঙ্গে নবযুগ পুণঃপ্রকাশ হলো। চললোও ভাল। নজরুল শুধু সম্পাদকীয়ই লিখতেন না। তিনি কবিতা লিখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি একটি সম্পাদকীয় লেখেন, তিনি জিন্নাহকে ‘কাফের’ এবং পাকিস্তানকে ‘ফাঁকিস্তান’ লেখার কারণে মুসলিম লীগ-এর সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হলেন। এ সময় ‘দৈনিক আজাদ’ এই সম্পাদকীয়র বিরুদ্ধে নজরুল ইসলামকে কঠোর ভাষায় গাল দিয়ে সম্পাদকীয় লেখে। উল্লেখ্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং এ কে ফজলুল হকের যে আপোসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা এই লেখার কারণে ভণ্ডুল হয়ে যায়।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা আকরাম খান কারারুদ্ধ হলে কাজী নজরুল ইসলাম কিছুদিনের জন্য আকরাম খান সম্পাদিত ‘দৈনিক সেবক’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য নজরুল সে সময় কুমিল্লায় ছিলেন। তাঁকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন সেবক কর্তৃপক্ষ। এরপর নজরুল কলকাতা গিয়ে দায়িত্ব নেন।

নজরুলের সাংবাদিক- প্রতিভার সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য স্ফূরণ ঘটে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে। মেটকাফ প্রেসে ছাপানো হয় পত্রিকাটি। এর মুদ্রাকর হন আফজাল-উল-হক এবং কর্মসচিব হন শান্তিপদ সিংহ। প্রথমে অফিস ছিল ৩২ কলেজ স্ট্রীটে। পরে স্থানান্তর হয় সাত নম্বর প্রতাপ চাটুজ্যে লেনের একটি বাড়িতে। এই পত্রিকার প্রবন্ধের পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণী লেখা থাকতো। পত্রিকাটি ছাপা হতো দুই হাজার। মোড়ে মোড়ে তরুণের দল কাগজটি কেনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো। বিক্রির সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকলে গ্রাহকরা আগাম টাকা দিয়ে রাখতো হকারকে। হকার যখন কাগজের বান্ডিল নিয়ে আসতো তখন হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি লেগে যেত। এক কপি কাগজ নিয়ে চায়ের দোকানে পাঠকদের ভিড়; ছাত্রদের হোস্টেলে, বৈঠক ঘরে সর্বত্র আলোচনা চলতো এর লেখা নিয়ে। কালি তো নয় যেন রক্তে লেখা সে সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। ধূমকেতু জাতির অচলায়তন মনকে জাগিয়ে তুললো। তবে রাজশক্তি প্রমাদ গুণতে শুরু করলো। যেমন নজরুলের লেখা, তেমনই শক্তিশালী লেখা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি লিখতেন ‘ত্রিশূল’ ছদ্মনামে। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই নজরুলের বিখ্যাত ‘ধূমকেতু’ কবিতা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে নজরুল যে জ্বালাময়ী ওজস্বিনী রচনা লেখেন, এর মধ্য থেকে কিছু তাঁর ‘রুদ্রমঙ্গল’ ও ‘দুর্দিনের যাত্রী’ বইতে স্থান পায়।

ধূমকেতুর প্রকাশকে স্বাগত জানিয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকা  আশাবাদ ব্যক্ত করে লেখা হয় : ‘সৈনিক কবির হাতে ‘ধূমকেতু’ শুধু ধ্বংসের প্রতীক না হয়ে সুন্দর স্থায়ী ও পবিত্র  কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে।’

অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতায় ঝিমিয়ে পড়া ও নৈরাশ্যপীড়িত সন্ত্রাসবাদীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ‘ধুমকেতু’ যে দুরূহ ও দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে, ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ‘ধূমকেতু’, ‘বিজলী’, ‘শঙ্খ’ ও ‘আত্মশক্তি’কে ছাড়িয়ে  যায়। নজরুল লিখেছিলেন ‘‘ধূমকেতু’ কোনো সম্প্রদায়ের কাগজ নয়। মনুষ্য ধর্মই বড় ধর্ম’’। তিনি ধূমকেতুতেই প্রথম লেখেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির কথা। নজরুল ‘ধূমকেতু’তে  অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা যুগিয়েছেন। ‘আমি সৈনিক’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘এখন দেশে সেই সেবকের দরকার যে সেবক দেশ-সৈনিক হতে পারবে।… রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, প্রফুল্ল বাঙলার দেবতা, তাদের পূজায় বাঙলার চোখের জল চির নিবেদিত থাকবে। কিন্তু সেনাপতি কই ? সৈনিক কোথায় ? কোথায় আঘাতের দেবতা, প্রলয়ের মহারুদ্র ? সে পুরুষ এসেছিল বিবেকানন্দ, সে সেনাপতির পৌরুষ-হুঙ্কার গর্জে উঠেছিল বিবেকানন্দের কন্ঠে।’

ধূমকেতুর ২০তম সংখ্যায় তিনি ‘ভিক্ষা দাও’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন : ‘ভিক্ষা দাও! ওগো পুরবাসী ভিক্ষা দাও। তোমাদের একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও। আমাদের এমন একটি ছেলে দাও যে বলবে আমি ঘরের নই, আমি পরের। আমি আমার নই আমি দেশের।… তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি নেই যে বলতে পারে আমি আছি; সব মরে গেলেও আমি বেঁচে আছি; যতক্ষণ ক্ষীণ রক্তধারা বয়ে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তা দেশের জন্য  পাত কোরব। ওগো তরুণ, ভিক্ষা দাও তোমার কাঁচা প্রাণ ভিক্ষা দাও।’

ধূমকেতু’র মাধ্যমেই কবির বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দিনের পর দিন তিনি যেমন সমাজের জড়তা ও অন্ধতা দূর করার উদ্দেশ্যে প্রবলভাবে আঘাত হেনেছেন, তেমনি বিদেশি রাজশক্তির বিরুদ্ধে গণবিপ্লবের উদ্বোধনার্থে অগ্নিগর্ভ বাণী প্রচার করেছেন। ‘ধূমকেতু’ নারীদের নানা সমস্যা আলোচনা করে তাদের জাগরণেরও চেষ্টা করতো। এর সন্ধ্যাপ্রদীপ  বিভাগে থাকতো শুধুই নারীদের বিষয়।

ধূমকেতু-তে প্রকাশিত অনেক রচনার জন্যই নজরুলকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যেত। কবিতা, অগ্নিগর্ভ প্রবন্ধ, হাস্যকৌতুক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তিনি একদিকে শাসক শ্রেণির অত্যাচার, অবিচার ও শোষণ এবং অপরদিকে হিন্দু-মুসলমান সমাজের জড়তা, দুর্নীতি ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনি চালিয়ে যান। তিনি এসময় একটি প্রবন্ধ লেখেন : ‘মেয় ভুখাঁ হুঁ’। এরপর লেখেন, ‘আনন্দময়ীর আগমন।’ এই প্রবন্ধ লেখার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়। বিচারে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তিনি আদালতে যে জবানবন্দী দেন তা শুধু একজন সত্যিকার মানব প্রেমিকের জীবনভাষ্যই নয়, তা উচ্চমার্গের সাহিত্য রচনাও।

সম্পাদকীয় প্রবন্ধ হিসেবে ধূমকেতুর প্রবন্ধগুলি অতিমাত্রায় কাব্য-গুণান্বিত। এগুলোতে আবেগোচ্ছ্বাস যতটা, নেই সেই পরিমাণে বিচার- বিশ্লেষণ। তবে দেশের যৌবন- রক্তে এই সব দুঃসাহসী ও নির্ভিক প্রবন্ধ যে আবেগ ও উদ্দীপনার অগ্নি সঞ্চার করেছিল এ কথা নির্দ্বিধায়  বলা যায়। ‘ধূমকেত’ স্তিমিত হওয়া সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকে অনেকটাই উদ্দীপ্ত করেছিল।

সংবাদের শিরোনাম বা হেডিং রচনা ও সংবাদ সংক্ষেপ করার যে দক্ষতা নজরুল ‘নবযুগ’ সম্পাদনাকালে দেখান তারই পরিণত রূপ ব্যক্ত হয় ‘ধূমকেতু’তে। সংবাদ পরিবেশন ও তার হেডিং প্রণয়নে মন্তব্যে এবং মাঝে মাঝে রঙ্গব্যঙ্গের ছোট ছোট কবিতা ও প্যারোডির ব্যবহারে সংবাদগুলি হতো উপভোগ্য, তেমন মর্মস্পর্শী। কথ্যভাষায় আরবি, ফারসি, দেশি শব্দের নিপুণ প্রয়োগে সেগুলো হতো তীক্ষ্ন ও প্রাণবন্ত। খবরগুলো সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত থাকতো- দেশের খবর, পরদেশী পঞ্জী ও মুসলিম জাহান।

এ রকম কয়েকটি শিরোনাম : অমৃতবাজার পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক মতিলাল ঘোষ-এর মৃত্যু সংবাদের শিরোনাম, ‘মর্তের মতিলাল স্বর্গে’। বোম্বাই প্রদেশ কংগ্রেসের কমিটির কয়েকজন গভর্নমেন্টের গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচর হিসেবে ধরা পড়ার সংবাদের শিরোনাম ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা/ ঘর শত্রু বিভিষণ’। সত্যগ্রহ যুদ্ধ নতুন করে আরম্ভ হলে খবরের শিরোনাম দেন ‘দুঃশাসনের বস্ত্রহরণ’। মুলতান ও তেলেনিপাড়ায় মহরম উপলক্ষে মারামারি হলে খবরের হেডিং দেন ‘ মহরম নিয়ে দহরম-মহরম’। বার্লিনে পুলিশের সাথে কমিউনিস্ট মিছিলকারীদের হাঙ্গামার খবরের শিরোনাম ‘পুলিশে-কুলিশে’। পরদেশী খবরের হেডিং ‘ দাড়িতে আগুন লেগে অক্কা/ টরে টক্কা টরে টক্কা’- অর্থাৎ জন বায়ওয়াইজ জউথওয়েট নামের স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। তিনি আঁধার রাতে ঘড়ি দেখার জন্য দেশালাই জ্বালালে দাড়িতে আগুন লেগে যায় এবং তিনি মারা যান। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তুরস্কের সংগ্রাম সমর্থন করে একটি সংবাদের শিরোনাম ‘চালাও যুদ্ধ চালাও’। তারপর মন্তব্যসহ সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে ‘সে মানে না মানা/ লাঠি দেখালেই বলে না না।’ ইতালি সরকারের অবস্থা কাহিল। প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনিকে একটা রফা করার জন্য তারবার্তা পাঠিয়েছেন মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ এই খবরের শিরোনাম ‘শুদ্রেরা সব জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। বাবুরা হুসিয়ার।’ দিল্লীতে এক শিশু ট্রামের নিচে পড়ে কাটা পড়ে মারা গেলে ট্রাম চালককে জনতা মারপিট করে এবং পুলিশ তাকে আটক করে এই খবরের হেডিং দেয়া হয় ‘এসব কন্ডাক্টর  ব্যাটাদের তুলো ধোনা করাই উচিৎ।’ ডাবলিনে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য চরমপন্থীরা বেশ কয়েকটি বোমা রেখেছিল। তারই একটি ফেটে বিকট শব্দ হয়েছিল। এই খবরের শিরোনাম দেন  ‘বোম ভোলানাথ’।

উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, নজরুল ইসলামের নিউজ সেন্স বা সংবাদ চেতনা বেশ লক্ষ্যণীয় মাত্রাতেই ছিল। বাঙলা ভাষায় সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘ধূমকেতু’ যে  একটি সরস অথচ তীক্ষ্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল, এ কথা অবশ্য স্বীকার্য। সাংবাদিক জীবনের নিষ্ঠা, কর্তব্যজ্ঞান, নির্ভীকতা ইত্যাদি সদগুণের দুর্লভ সমাবেশ ঘটেছিল নজরুলের মধ্যে।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে (২৫ ডিসেম্বর) লেবার স্বরাজ পার্টির একটি মুখপত্র ‘লাঙল’ প্রকাশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম সেটির পরিচালক নিযুক্ত  হন এবং সম্পাদক  হন  তাঁর বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন নাম মাত্র সম্পাদক। সকল কাজই করতেন নজরুল। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধলে ‘লাঙল’ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা হ্রাস পায়। এর পর ‘লাঙল’-এর নাম পরিবর্তন করে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট ‘গণবাণী’ প্রকাশিত হয়। গণবাণীতেই তিনি লেখেন প্রবন্ধ  ‘মন্দির-মসজিদ’।

সাংবাদিকতার ইতিহাসে এদেশে নজরুলের ভূমিকা বিশাল। সেটা বিস্মৃত হওয়ার নয়।  মানুষকে জাগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রচনাসমূহের ঐতিহাসিক মূল্যও কম নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top