সকল মেনু

একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয় না

 আফিফা জামান : আহমদ ছফাকে নিয়ে আমার একটি লেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশের পর বিপুল সাড়া মেলে। দেশ-বিদেশ থেকে ফোন আসতে থাকে লেখাটিকে আরো কয়েক পর্বে লেখার জন্য। সেই সব টেলিফোনের চেয়ে আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি আমার বন্ধু কবি সাখাওয়াত টিপু’র পরামর্শ। কবিবন্ধু সাখাওয়াত টিপু, অনুজ এহসান ইসলাম এই লেখাটি কমপক্ষে দশ পর্বে লেখার তাগিদ দিয়েছে। আহমদ ছফা সম্পর্কে লেখা আসলেই জরুরি। কারণ তিনি যে মাপের মানুষ সেদিকে তাকালে তাকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য লেখালেখির পরিমাণ খুবই কম। ইদানিং সময়ে দেখি কেষ্ট-বিষ্টুদের নিয়ে কত বই প্রকাশিত হয়, তাদের ভালো করে চিনিও না। অথচ আহমদ ছফা’র মতো একজন পণ্ডিতকে নিয়ে যত বই প্রকাশিত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বই প্রকাশের দাবি রাখে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? এ সংকটই সম্ভবত ছফা ভাইয়ের বেলায় সবচেয়ে বড় সংকট। যাই হোক, আজকে ছফা ভাইকে নিয়ে আরেকটি লেখা লিখবো বলে কয়েক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু সেখানেও দেখা দিল আরেক সংকট- ছফা ভাইয়ের কোন দিক নিয়ে লিখবো? সে মীমাংসায় আসতে পারিনি। তাছাড়া এসব লেখা যখন লিখছি আমার হাতের কাছে তথ্য প্রমাণ কিছুই নেই (খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে)। সুতরাং  স্মৃতি থেকেই লিখতে হচ্ছে। ছফা ভাইকে আমার নারকেলের মতো মনে হতো। নারকেলের ভেতরের কোমলতাই এর বড় কারণ। অথচ এই ফলটির  বাইরের খোলস দেখে কিন্তু এই কোমলতা বোঝার উপায় নেই। আমি প্রথম যখন শাহবাগ যেতাম তখন ‘উত্থানপর্ব’ দোকানটিতে ছফা ভাইকে বসা দেখতাম। তার আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরা থাকত। খুব আয়েশ করে তিনি তাতে টান দিতেন। প্রতিটি টানই ছিল তার কাছে সুখ টানের মতো। একটার আগুন দিয়ে আরেকটা ধরাতেন। এভাবেই তাকে দূর থেকে দেখতাম।
একদিন উত্থানপর্বে একটি লেখা নিয়ে  হাজির হলাম। এবং তার কাছে গিয়েই জানতে চাইলাম,  দেখুন আমি আহমদ ছফা সাহেবকে খুঁজছি। উনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?
একটু দম নিয়ে ছফা ভাই উত্তর দিলেন, দেখুন, এখন তো সাহেবদের দিন নেই, ব্রিটিশ চলে গেছে অনেক আগেই। ছফা সাহেবকে এখন পাওয়া যাবে না। আমি আহমদ ছফা, যা বলার আমাকে বলুন। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমার লেখাটা উত্থানপর্বে প্রকাশের জন্য বললাম। তিনি বললেন, লেখাটি রেখে যান। আমি যথারীতি লেখাটি রেখে দু’কদম সামনে এগুতেই তিনি পুনরায় ডাক দিয়ে ফেরালেন। তারপর চেয়ার টেনে বেসতে বললেন। আমি গ্রাম থেকে আসা ছেলে। গা থেকে সোঁদা মাটির গন্ধ তখনো যায়নি। লেখাটা দিতেই আমার বুকের ভেতর ঢেঁকির পাড়ের ঢিপ্ ঢিপ্ শব্দ শুনছিলাম। অতবড় মাপের একজন লেখকের মুখোমুখি এর আগে কখনও হইনি। সুতরাং কী বলেন, সংশয়ে ছিলাম। লেখাটি দিয়ে ঝামেলা ঝেড়ে ফেললেও তার পিছু ডাকে মনে হলো, কিছু একটা অপরাধ হয়তো হয়েছে।

তার সামনের চেয়ারে বসবো কি বসবো না, এই নিয়ে ইতস্তত করতে লাগলাম। ছফা ভাই ব্যাপারটি অনুভব করলেন। এবং বললেন, দেখুন, আমাকে সম্মান করলে আপনি স্বাভাবিকভাবেই করতে পারেন। তার জন্য চেয়ারে বসা বা সিগারেট খাওয়া কোনো অন্তরায় নয়। এই অন্তরায়গুলো সামাজিক সৃষ্টি। তাই এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো। ছফা ভাই চায়ের অর্ডার দিলেন। আমি চা খেলাম। এর মধ্যেই চলছিল কথোপকথন। তিনি আমার নাম-ধামসহ সব খবর জেনে নিলেন। এভাবেই সেখানে আমার যাওয়া আসা কিছুটা নিয়মিত হলো।

বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে ছফা ভাই বোঝাতেন, দেশের মূল অবস্থা। একদিন তিনি বললেন, আমাদের মস্তিষ্কের উপনিবেশ না ভাঙা পর্যন্ত আপনি যতই সমাজ বিপ্লব করেন, কোনো লাভ হবে না। সময় নষ্ট হবে। ওর চেয়ে পড়াশোনা করেন। আমাদের শরীর থেকে এখনো ব্রিটিশের চাবুকের ক্ষত শুকায়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো। ব্রিটিশের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে পক্ষ হলো দুটো- একটা মোহন লাল করমচাঁদ গান্ধী, অন্যটি জিন্নাহ্ সাহেবদের। মানে দেশ ভাগের ঠিকা নিলেন- কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। ব্রিটিশ বিদায়ের আগে ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান একটি রাষ্ট্রে বসবাস করতে সম্মত হয়নি বলেই ব্রিটিশ ভারতকে ভারত এবং পাকিস্তান দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যে পাকিস্তান কিন্তু ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির অল্প কালের মধ্যেই আমাদের দেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্বাঞ্চলে মানুষের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী চেতনা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে থাকে। এর প্রধান কারণ ছিল- ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের অনিশ্চয়তা। এবং আপনি যদি ভারতচন্দ্র পড়েন তখন দেখবেন, তার কবিতার একটি লাইন আছে, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’।
কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্বাঞ্চলের মানুষের যেন সম্বিত ফিরলো। সে দেখলো, যে রাষ্ট্রকে সে মুসলমানদের রাষ্ট্র ভেবেছে সেই রাষ্ট্র তার সন্তানকে গুলি করে মেরে ফেলে। এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর পাকিস্তান বিরোধীতা তীব্রতা পায়। এসব কাহিনি যদি না জানেন, শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ’ করে লাফালে কোনো কাজ হবে না। কারণ একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয় না। সে স্বাধীনতা লাভ করে বটে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষ করতে হলে, দেশটির সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ সবচেয়ে বেশি জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে চিত্র ভিন্ন। এখানে মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধীতা করেছে কায়দা করে তারাই রাষ্ট্রের সুবিধার জায়গাটিকে আঁকড়ে রেখেছে। আপনারা এখন যারা মিছিল করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা হুঁশিয়ার সাবধান’, আমি আজ এখানে বসে আপনাকে সাবধান করে দিতে পারি, রাষ্ট্র শক্তি এখনো যদি আমলা, ধনিক শ্রেণীর মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের নির্মূল করতে না পারে একদিন এজন্য এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এই মিছিল করার কারণে আপনার বিচার করবে।
আজ দেখছি, ছফা ভাইয়ের সেই ভবিষ্যৎ বাণী হাড়ে হাড়ে ফলে গেছে। ধর্মীয় মৌলবাদের যে উত্থান তাতে টেকাই দুষ্কর। এই বাস্তবতা ছফা ভাই বুঝেছিলেন আরো দুই যুগ আগে। প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন কালের কথক। ছফা ভাই আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি আমার ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইটি পড়েছেন?

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লে তিনি বললেন, ওই পড়ায় হবে না। আবার নতুন করে পড়ুন। ছফা ভাইয়ের আলোচনা শোনার পর বইটি আমার কাছে পুরোপুরি ভিন্ন মাত্রার একটি বই মনে হলো। আমার চিন্তার জগতে যতগুলো বই প্রভাব ফেলেছে সেগুলোর মধ্যে এই বইটি অন্যতম। বইটি থেকে ক্ষুদ্র একটি অংশ পাঠকের জন্য তুলে দিলাম :
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর প্রয়োজন সবচাইতে অধিক ছিল। একটি সর্বব্যাপ্ত জাগরণ, নতুন মানসিক বোধের উদ্বোধন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক একটা উত্থানের ঢেউ লেগে শিল্প, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের কোনো শাখা ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে যে সকল ব্যক্তি, পাকিস্তান সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ভেতর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধীতা করে জাতীয় আন্দোলনের প্রতি কখনো ক্ষীণ, কখনো জোড়ালো সমর্থন ব্যক্ত করার চেষ্টা করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় তারা একটা নিরাপদ অবস্থান পেয়ে গেলেন। দেশটির সংস্কৃতির অভিভাবক নতুন ব্রাহ্মণের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় আত্মতুষ্টি এবং তোষামোদের এমন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে আরম্ভ করলেন, বাঙালী জনগোষ্ঠীর মুক্তি সংগ্রামের তরঙ্গ তার মধ্যে ধ্বণিত হয়ে উঠলো না। কৃষক, মজুর, দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক আত্মত্যাগ করেছে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো চিহ্নই তাদের চিন্তা চেতনায় স্থান করে নিতে পারেনি। তারাও বাঙালীর রাষ্ট্র, বাঙালী জনগণের কথা বলতেন, কিন্তু সেগুলো বিমূর্ত ধারণার অধিক কিছু ছিল না। বাস্তবে যে বাঙালী জনগণ প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম তরান্বিত করেছে, সেই হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জনগণকে এক সূত্রে বেঁধে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলার স্বপ্ন কখনো তাদের মনে সঞ্চারিত হয়নি।
(সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস- আহমদ ছফা)

তখন আমি অধুনালুপ্ত ‘আজকের কাগজ’-এ কাজ করি। অফিস ধানমন্ডিতে। আমি গোপীবাগ থাকি। অফিস শেষে যাওয়ার পথে ছফা ভাইয়ের অফিস হয়ে যাই। হঠাৎ একদিন সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান কথাসাহিত্যিক সালাম সালেহ উদ্দিন আমাকে বললেন, আপনি কি আহমদ ছফা সাহেবকে চিনেন?

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লে তিনি বললেন, এখন থেকে তিনি যে আমাদের পত্রিকায় লিখেন ওটা আপনাকেই লিখে আনতে হবে (যাকে বলে ডিক্টেশন নেয়া)। আমি কোনো কথা না বললেও মনে মনে খুব খুশি হলাম। তখন বেতন পাই ২৫০০ টাকা। বই কেনার কারণে খরচটা একটু টেনেটুনে করতে হতো। তাই ইচ্ছে করলেই সব কিছু সব সময় খেতে পারতাম না। ছফা ভাইয়ের লেখা লিখতে গেলে যা খেতে চাইতাম, তিনি তাই খাওয়াতেন। আমার মনে হতো, ছফা ভাইয়ের ভেতরে এক ধরনের মাতৃত্ব লুকিয়ে আছে। তিনি দেখামাত্র বুঝতে পারতেন খেয়ে এসেছি, না গিয়ে খাবো। কিছু খাওয়ার পরে চা খেয়ে গল্প করে, তারপর লেখা শুরু হতো বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পাশের বাসায় অথবা উত্থানপর্বে বসে। লেখা শেষে ছফা ভাই ১০০ টাকা হাতে গুজে দিতেন। বলতেন, এটা পারিশ্রমিক নয়, আমার অক্ষমতার দণ্ড। এই টানাটানির মধ্যে একদিন ছফা ভাইয়ের জন্য বড় বড় দু’টো আম কিনে নিয়ে গেলাম।
ছফা ভাই আমাকে কাটতে বললেন। আমি বললাম, আমি খাব না। শুনে ছফা ভাই খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনি যা খাবেন না, তা কারো জন্য নেবেন না। আপনার এ আম আমি খাব না।
আমি খুব বিব্রত হলাম। ছফা ভাই আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর অন্যদিকে ফিরে গান শুরু করলেন- ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না…।

আমি কোনো মতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। কারণ ছফা ভাইয়ের এই রুদ্র মূর্তি দেখতে তখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। ওই দিন চলে আসলাম। পরের দিন আবার যেতে হলো ছফা ভাইয়ের লেখার বিল নিয়ে। সেদিন গেলাম ভয়ে ভয়ে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, বিল পেয়ে তিনি ১০০ টাকা পকেটে গুজে দিতেন। বলতেন, যা খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে নিবেন। তিনি লেখার আগেই বলে নিতেন, তার কোনো ব্যাংক একাউন্ট নেই, তাই টাকাটা নগদ দিতে হবে। যারা লেখা নিতেন, একথা মেনেই নিতেন।

পরের দিন গিয়ে দেখলাম, ছফা ভাই সেই রাগ আর ধরে রাখেননি। যাওয়ার পর তিনি একটার পর একটা গান হারমোনিয়াম বাজিয়ে শোনাতে লাগলেন। এক সময় ক্ষান্ত দিয়ে বললেন, কেমন লাগলো, সত্যি করে বলবেন কিন্তু?

আমি বললাম, ভালই, তবে সব গানের সুর তো এক। ছফা ভাই রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, সুর সম্বন্ধে আপনার ধারণা নেই। আপনি ছায়ানটে গিয়ে ভর্তি হবেন। টাকা আমি দেব।

তখন ছায়ানটে আমি ভর্তি হইনি। হয়েছি অনেক পরে। ততদিনে ছফা ভাই আর বেঁচে নেই। এখন এস্রাজে বা বাঁশিতে শিবরঞ্জন রাগ বাজলেই ছফা ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। (চলবে)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top