সকল মেনু

ঠিকানা নতুন

 আফিফা জামান,১৭জুন :  রিকশায় প্যাডেল মারতে মারতে সোনা মিয়া তার হারিয়ে যাওয়া গ্রামে ফিরে যায়। শ্যামল গাঁয়ের মাটির গন্ধ যেন তার নাকে ভেসে আসে। সোনা মিয়ার কঠিন মুখে কোমল হাসির রেখা ফুটে ওঠে। ব্রেক কষে প্রাইভেট কারটা হঠাৎ থেমে যায়। গাড়ির কাচের জানালা নামিয়ে মাথাটা বের করে ড্রাইভার সোনা মিয়াকে একচোট গালি বর্ষণ করে। সোনা মিয়া চুপ মেরে যায়। ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। রিকশা চালালে একমনে চালাতে হয়। তখন অন্য কোনো চিন্তা করতে নাই। রিকশা-মহাজন রফিক মিয়া বারবার সাবধান করে বলেছিল, ‘সাবধানে চালাইবা মিয়া।’ ‘আর ভুল অইব না,’ সোনা মিয়া মনে মনে শুধরে নেয় নিজেকে। এদিকে যুবক সোয়ারিও সোনা মিয়াকে গালাগাল শুরু করে, ‘কবে আইছস ব্যাটা ঢাকায়? কয়দিন থাইক্যা চালাস? দিছিলি তো এক্কেবারে চাক্কার নিচে হান্দায়া!’ ছেলের বয়সী এই যুবকের তুইতোকারিতে সোনা মিয়া ব্যথিত হয়। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। নীরবে সাবধানে রিকশা চালাতে থাকে সে। কয়েক দিন আগে ট্রাফিক পুলিশের লাঠির মাঝারি গোছের কয়েকটা আঘাত হজম করতে হয়েছিল। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। কী আজব শহর! কারো মনে একটু মোহাব্বত নাই। অথচ গ্রামে রাস্তায় কত ছেলেপেলে সালাম দিত। ট্রাফিক নিয়মকানুন এখন অনেকটা রপ্ত হয়েছে সোনা মিয়ার। তবু পুরোটা নিয়ন্ত্রণ আসেনি হাতে। চার মাস হয়ে গেল, সোনা মিয়া ঢাকায় এসেছে। এত মানুষ দেখে প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে একবার ঢাকায় এসেছিল সোনা মিয়া। পাশের বাড়ির লোকমান তাকে বেড়াতে নিয়ে এসেছিল। তখন এত লোকজন, এত গাড়ি ছিল না। কত উঁচু উঁচু দালানকোঠা উঠেছে শহরে, কত সুন্দর সুন্দর দালান, তবুও কেমন যেন খালি খালি লাগে। নিজের হারিয়ে যাওয়া গ্রামের মতো আপন মনে হয় না শহরটাকে। শহরের মানুষগুলোকেও সোনা মিয়ার পছন্দ হয় না। কেমন যেন স্বার্থপর, দয়ামায়াহীন। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই মানুষগুলোও যেন রিকশার মতো গড়িয়ে যাচ্ছে; মানুষগুলোর প্রাণ নেই। সোয়ারিকে নামিয়ে দিয়ে সোনা মিয়া মোড়ের একটা গাছের ছায়ায় রিকশা থামিয়ে গামছায় ঘাম মোছে। নদীভাঙা মানুষকে কেউ বুঝতে চায় না। সোনা মিয়ার মতো তো নদী সর্বস্বান্ত করেনি এই শহুরে মানুষগুলোকে, কী করে বুঝবে তারা? হঠাৎ সোনা মিয়ার প্রচণ্ড রাগ হয়। কপালের দুপাশের শিরা ফুলে ওঠে। চোখ বিস্ফারিত হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করে। বিড়বিড় করে গাল দেয় কাকে যেন। প্রথম দিকে একটু ভদ্রস্থ কাজ খুঁজেছে সোনা মিয়া। অবশ্য এই খোঁজাটা ছিল মনে মনে। এ শহরে কাজ পাবে কোথায়! কৃষিকাজ তো নেই। এখানে মাটি নেই। আছে ইট, পাথর, লোহালক্কড় আর মোটরগাড়ি। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি যান্ত্রিক শব্দ সোনা মিয়ার মাথায় ভেঙে পড়ে। কৃষিকাজ জানা সোনা মিয়ার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। গাঁটের টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে ভিক্ষা করে খেতে হবে। শহরের মানুষ কি ভিক্ষা দেয়? নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে তার। প্রতি শুক্রবার ফকিরকে ভিক্ষা দিত তারা। বাজারে রাধেশ্যামের দোকান থেকে টাকা খুচরা করে নিয়ে আসত। রাধেশ্যাম শণপাপড়ি বেচত। ‘রাধুটা এখন কোথায় আছে কে জানে,’ মনে মনে ভাবে সোনা মিয়া, ‘যেখানেই থাক, রাধু খারাপ থাকবে না। অল্প পুঁজির এ ব্যবসা সবখানেই করতে পারবে।’ রাধুর সঙ্গে সোনা মিয়ার কী ভাবই-না ছিল। মাঝে মাঝে রাধু তার ব্যবসায় বন্ধ দিত। সোনা মিয়ার জমির আলে বসে গল্পগাছা করত। আর প্রায়ই বলত, ‘সোনা রে, এই শণপাপড়ি বেচতে আর ভালো লাগে না। তোর মতন যদি আমার চাষের জমি থাকত, চাষবাস করতাম। চাষবাস অইল পুরুষের কাম।’

মনে মনে সোনা মিয়া খুশিতে ডগমগ করত। কিন্তু মুখে বলত উল্টো কথা, ‘শণপাপড়ি বেচা খারাপ কী? ছোট ছোট দুধের বাচ্চাগো কাছে বেচতে তো ভালোই লাগার কথা।’

আজ মনে হয় রাধুই ভালো আছে। বলদ জোড়া বেচে দিয়ে এসেছে সোনা মিয়া। যে হাতে একদিন লাঙল চালাত, সে হাতে এখন রিকশার হ্যান্ডেল।

বস্তিতে ফিরে শরীর ভেঙে পড়ে। কোথা থেকে যে ঘুম চলে আসে সোনা মিয়ার দুচোখে। তন্দ্রা ভাবটা কেটে গেলে তোলা পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। একমাত্র মেয়ে রুমা গামছা এগিয়ে দেয়। ক্লাস টেনে উঠেছিল রুমা। পড়ার মাথা ছিল ভালো। সোনা মিয়ার কত স্বপ্ন ছিল মেয়েকে নিয়ে। কলেজে পড়াবে, শিক্ষিত ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দেবে। গামছায় হাত-মুখ মুছতে মুছতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে সোনা মিয়ার বুকের ভেতর থেকে। মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়। ‘খাইছস মা?’ মেয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বাবাকে জানান দেয়, আজ শেষ রোজা, তাই মেয়ে রোজা রেখেছে।

এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেনি সোনা মিয়া। গ্রামের সবাই তাকে নামাজি লোক হিসেবে জানত।
রোজা-নামাজ, ধর্মকর্মে কখনো আনীহা ছিল না সোনা মিয়ার। আজ এই শহরে ঠাঁই নেওয়ার পরে তার রোজা-নামাজ কোথায় গেল? প্রথম রোজাটা অবশ্য রেখেছিল সে। রিকশার প্যাডেল মারতে মারতে ক্লান্তি এসে যায় সোনা মিয়ার। শরীরে বল পায় না। অবশ্য কায়িক পরিশ্রমের চেয়ে মানসিক যুদ্ধেই সে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তার গ্রাম আর এই শহর পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। যেন কবির লড়াই হবে। সোনা মিয়ার গ্রাম হারিয়ে যায়। সোনা মিয়া রাক্তাক্ত হয়। তার অস্তিত্ব নিঃশেষ হতে হতে একটা রিকশার হ্যান্ডেলের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেল বেজে ওঠে ক্রিং ক্রিং…।

‘কী ভাবতাছো বাজান,’ মেয়ের কণ্ঠস্বরে জেগে ওঠে সোনা মিয়া। মেয়ের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলে, ‘না রে মা, ভাবছিলাম কেমনে রিকশাঅলা হইয়া গেলাম, নামাজ-রোজা ভুইলা গেলাম।’

মেয়ে সান্ত্বনা দেয়, ‘এত্ত খাটাখাটনি করলে কি রোজা রাখন যায়?’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সোনা মিয়ার বুক থেকে।

ভাত খেতে খেতে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দ পায় সোনা মিয়া। স্ত্রী আমেনার মুখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমেনা বলে, ‘জাকাতের কাপড় আনতে গিয়া ফুলির মায় মইরা গেছে। ভিড়ের মধ্যে পায়ের নিচে পড়ছিল।’

সোনা মিয়া কোনোমতে ভাত গিলে ওঠে। আবার ক্লান্তি এসে ভর করে তার দেহ-মনে। শহরটা একসঙ্গে কল্পনা করতে চায়। যতবারই কল্পনায় শহরটার আদল আঁকতে যায়, ততবারই যেন শহরটা বড় হতে থাকে। বাড়তে বাড়তে পৃথিবীর চেয়ে বড় হয়ে যায় এ শহর। আ-জ-ব-শ-হ-র।

হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে সোনা মিয়া। পাখির কলকাকলিতে তার ঘুম ভাঙে। মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে উঠোনে পা রাখে। ‘এতক্ষণ কী একটি চাড়াইল্লা খোয়াব দেখছিলাম। কই রিকশা! আমার এই সোনার গেরাম থাকতে আমি রিকশা চালামু কেন? এই তো গোয়ালঘরের বেড়ার লগে ঠেকা দেওয়া লাঙল। বলদ দুইডা খেড় খাইতাছে। প্রজাপতির মতো পাখনায় ভর দিয়ে উড়তে উড়তে খেতের দিকে ছোটে সোনা মিয়া। কত ধান পেকে আছে। একি! ধানগুলি কাটা হয় নাই কেন, লোকজন কই?’

সোনা মিয়া আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে, কোথাও কোনো জনমনিষ্যি নাই। বিরান। নদীর কূলে ঝপাৎ করে পাড় ভেঙে পড়ে। ‘একি! ধানখেতে নদী আইলো কোনহান থিকা! ধানখেত কই?’ দূর থেকে সোনা মিয়া তার মেয়েকে দৌড়ে আসতে দেখে। কী যেন বলছে রুমা। অনেক কথা বলছে রুমা, অথচ সোনা মিয়া কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, শুধু ‘বাজান’ ডাক শোনা যাচ্ছে। ‘অ বাজান, ওডো, রিকশা জমা দিবা না। অনেক টাইম অইয়া গেছে। বাজান ওডো। অ বাজান…’

রুমা বাজানকে ডাকতেই থাকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top