সকল মেনু

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস : ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব

ধর্ম প্রতিবেদক, ২৬ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) :

স্বাধীনতা আল্লাহর অপূর্ব দান

প্রকৃতপক্ষে মানবজীবনে স্বাধীনতা মহান আল্লাহর অপূর্ব দান। স্বাধীনতার জন্য শোকর আদায় করে শেষ করা যায় না। স্বাধীনতা যে কত বড় মাপের একটি নিয়ামত, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধরাই কেবল তা অনুধাবন করতে পারেন। পরাধীনতা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য অর্জনের পথে অনেক বড় বাধা। পরাধীন মানুষ কখনো একান্তে বসে আল্লাহর ইবাদত করতেও সক্ষম হয় না। আল্লাহ মহানের কাছে কৃতজ্ঞ আমরা স্বাধীনতার মতো বিশেষ একটি নিয়ামত তিনি দান করেছেন আমাদের। নয় মাস রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার মতো বিশেষ নিয়ামত পেয়ে ধন্য হয়েছি আমরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে সুসংহত করা ও সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। ১৯৭১ সালে যারা আমাদের এ অমূল্য স্বাধীনতা অর্জনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন, সেসব শহীদ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। গোটা জাতি তাদের কাছে চিরঋণী। সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সবারই স্বাধীনতা রক্ষা ও ফলপ্রসূকরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। যে কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখে দেশগঠনে। এক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তারা নিজেদের অবস্থান থেকে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। জাতির প্রয়োজনে তাদের আরো সক্রিয় ভূমিকা সময়ের অনিবার্য দাবি। স্বাধীন দেশের ক্রান্তিলগ্নে সব ভেদাভেদ ভুলে দল-মত সবার ঐক্য প্রয়োজন। ইসলামে স্বাধীনতার মর্যাদা সম্পর্কে নবি করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, একদিন ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেয়া পৃথিবী ও তার অন্তর্গত সবকিছুর চেয়ে উত্তম। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তার আমল আর বৃদ্ধি পেতে পারে না। তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে ব্যক্তি কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার আমল কেয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং কবরের প্রশ্নোত্তর থেকেও সে মুক্ত থাকবে। (তিরমিজি, আবু দাউদ)। স্বাধীনতার মতো বিশেষ এ নিয়ামতকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা উচিত আমাদের। স্বাধীনতার অর্জন যাতে কোনোভাবেই ম্লান না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত।

ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব
স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ স্বাধীন। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে। আল্লাহতাআলা মানব জাতিকে সহজাত এমন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, সে নিরঙ্কুশ কোনো সত্তার কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে নতিস্বীকার করতে চায় না। আল্লাহতাআলা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টির সেরা জীবরূপে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়ে মানবজাতিকে অত্যন্ত সম্মানিত করেছেন। তাই মানুষ স্বাভাবিকভাবে এবং সঙ্গতকারণে স্বাধীনচেতা। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি সব ধরনের পরাধীনতা ইসলাম সমর্থন করে না। মানুষকে কোনো প্রকার দাসত্ব বা পরাক্রমশালী শত্রুর অত্যাচার ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যাবে না- পবিত্র কোরান থেকে এ চেতনা লাভ করা যায়।

ইসলামে স্বাধীনতার লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের অনুগমন ও সর্বত্র এর প্রতিফলন। ইসলামের নবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) একটি স্বাধীন ভূখণ্ড লাভের জন্য কঠোর সাধনা করেছিলেন। পৃথিবীতে চিরসত্য, ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে সামষ্টিকভাবে সমর্পিত হওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর তিনি ও তার সাহাবিরা মদীনায় হিজরতের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সে স্বাধীনতার বিস্তৃতি ও পূর্ণতা অর্জিত হয়েছিল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করে নবি করিম (সা.) ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোতরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। মহানবি (সা.)-এর কল্যাণমূলক আরব রাষ্ট্র সারা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি চিরন্তন আদর্শের নমুনা হয়ে আছে। ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় জোরালো ভূমিকা পালন করার তাগিদ দিয়েছে। রাসুল (সা.) হিজরত করার পর মদিনাকে নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের অনেক প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল মদিনা রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য। ইসলাম স্বাধীনতার জন্য শুধু উদ্বুদ্ধই করে না, বরং স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ মুক্তি সংগ্রাম, গণআন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ বা কঠিনতম কর্মের মাধ্যমে আত্মদানকারী অসংখ্য দেশপ্রেমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহান নেতাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আমাদের দেশ ও মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তারা অতি মহান। তারা দেশ ও জাতির গৌরব। ইসলামের দৃষ্টিতে তারা শহীদ, শাহাদতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে শাহাদত বরণ করেন, তাদের সম্পর্কে কোরানে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের তোমরা মৃত বল না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।’ -সুরা বাকারা : ১৫৪

স্বাধীনতা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্যই এক বিশেষ নিয়ামত। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ স্বাধীন। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে। এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সহজাত এমন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে সে নিরঙ্কুশ কোনো সত্তার কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি সব ধরনের পরাধীনতা ইসলামে সমর্থনীয় নয়। ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জোরালো তাগিদ দিয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরত করার পর মদিনাকে নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

ইসলামে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব 
স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। মানবজীবনে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনকে গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা ও উৎসাহিত করা হয়েছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো প্রকারের, কোনো ধরনের পরাধীনতা ইসলামে সমর্থনীয় নয়। পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে, যে মুক্ত করে তাদের, তাদের গুরুভার হতে ও শৃঙ্খল হতে যা তাদের ওপর ছিল, সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে এর অনুসরণ করে তারাই সফলকা। (সুরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৫৭) ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৈৗমত্ব রক্ষার জোরালো তাগিদ দিয়েছে। কেবল স্বাধীনতার প্রতি শুধু উদ্বুদ্ধই করে না, বরং স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করে। ইসলামের দৃষ্টিতে তারা শহীদ, শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে তারাও শহীদ। কারণ, দেশের জন্য, দেশপ্রেম হৃদয়ে নিয়ে মজলুম জনতার দাবি আদায়ের স্বার্থে লড়াই করা আল্লাহর পথে লড়াই করারই নামান্তর। পবিত্র কোরানে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৪) দেশ তথা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত লোকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন সম্পর্কে নবিজি (সা.) বলেছেন, রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেয়া পৃথিবী ও তার মধ্যকার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তার আমল আর বৃদ্ধি পেতে পারে না। তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তার আমল কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং কবরের প্রশ্নোত্তর থেকেও সে মুক্ত থাকবে। (তিরমিজি, আবু দাউদ)

স্বাধীনতা একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রথম অধিকার। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে শুরু করে সব ধরনের স্বাধীনতাকে ইসলামে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। ইসলামের নবি মুহাম্মদের (সা.) সারা জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্যের অন্যতম ছিল মজলুম জনতার স্বাধীনতা অর্জন করানো এবং প্রভুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করানো। পৃথিবীতে যখন যেখানে মানুষের ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে, মানুষ হারিয়েছে তার নিজস্বতাÑস্বাধীনতা, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবতার দাবি। মহান আল্লাহ সেখানেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন মজলুম মানবতার আবেদনকে। মিসরের ইতিহাসে হজরত মুসার (আ.) আগমনের পেছনে ফিরাউনের একনায়কতন্ত্র এবং তার ইচ্ছাস্বাধীন শাসনকে পরাজিত করানোই মূল উদ্দেশ্য ছিল। ব্যক্তি অধিকারবঞ্চিত পরাধীন মানুষের জন্য মানবতাবাদ আর স্বাধীনতার বাণী নিয়ে জাহেলিয়াতের যুগে আগমন ঘটেছিল সর্বশেষ নবি মুহাম্মদের (সা.)। আরবের মানুষ যখন পরাধীনতার কালো যুগের অধিবাসী, আমাদের শেষ নবি তখন এসেছিলেন স্বাধীনতা আদায়ের বাণী নিয়ে। মানুষকে স্বাধীন করে প্রভুর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দিতে এসেছিলেন তিনি। সর্বোপরি মানবতার মুক্তির দাবিই ছিল প্রত্যেক নবির পৃথিবীতে আগমনের কারণ এবং তারা জানতেন-বুঝতেন একজন পরাধীন ব্যক্তি সবসময় প্রভুর সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। পরাধীনতা প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনের অন্তরায়, বড় বাধা। ইসলাম স্বাধীনতা অর্জন করা এবং পরাধীনতা মুক্ত থাকার ব্যাপারে বেশ গুরুত্বারোপ করেছে। প্রশ্ন জাগতে পারে ব্যক্তি অধিকার বা ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজন কী এবং ইসলামের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? একজন আÍনিয়ন্ত্রণ অধিকারহীন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাবঞ্চিত মানুষ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যেমন পিছিয়ে, প্রভুর ইবাদতের ক্ষেত্রেও তেমনি পিছিয়ে থাকে। ইবাদতের জন্য এবং মহান আল্লাহর দরবারে কবুলযোগ্য আমলের জন্য যে প্রস্ফুটিত মন প্রয়োজন পরাধীনতা তাকে হত্যা করে দেয় চিরতরে। সুতরাং একজন মানুষের জন্য পরাধীনতা মুক্ত থাকাটা আবশ্যক।

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাসুল [সা.]-এর ভূমিকা
স্বাধীনতা একটি সাধ ও স্বপ্নের নাম। এর মর্মার্থ কেবল সে-ই অনুধাবন করতে পারবে যে পরাধীনতা ভোগ করেছে। স্বাধীনতা একটি জাতির কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত অর্জন। তাই তো এই স্বাধীনতার জন্য মানুষ অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। স্বাধীনতা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য একটি বিশেষ নিয়ামত ও মানুষের জন্মগত অধিকার। এজন্যই হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক মানব সন্তান ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। এই প্রকৃতি বা ফিতরাতের মধ্যেই স্বাধীনতার মর্মকথা নিহিত। প্রত্যেক মানুষ চায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে। স্বাধীনতাব্যতীত কোনো জাতি কখনো বেঁচে থাকতে পারে না। স্বাধীনতাই মানুষের অস্তিত্বে লালিত সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিকে ক্রমাগত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বিকশিত করতে সহায়তা করে। আর তাই তো দেখা যায় এ চির সত্যকে উপলব্ধি করে গণতান্ত্রিক জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুগে যুগে অনেক জাতি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ-সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়েছে। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামে অনেক ব্যক্তিই তার যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে স্বাতন্ত্র্য আবাসভূমি নির্মাণের প্রয়াস পান। ইতিহাসের এমনি একজন মহানায়ক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)।

নবি (সা.) আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে মদিনা নগরীতে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মদিনাকে স্বাধীন করেছিলেন সুদখোর, চক্রান্তবাজ, ভণ্ড, ইহুদিদের কবল থেকে। তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিতকে মজবুত করার নিমিত্তে মদিনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সব জাতি ও সম্প্রদায়ের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন- যা মদিনা সনদ নামে খ্যাত। একটি স্বাধীন কল্যাণ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এটিই পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র কিংবা সংবিধান। এ সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ব্যক্ত হয়েছে তা হলো-জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। এছাড়া চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ দান করে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক এ উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা সুরক্ষায় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ 
দেশপ্রেম অর্থাৎ দেশকে ভালোবাসা ইমানের অঙ্গ। মাতৃভূমিকে ভালোবাসা, মাতৃভূমির মানসম্মান এবং সম্পদ রক্ষা ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের ইমানি দায়িত্ব। ইসলামে দেশপ্রেমের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন প্রিয়মাতৃভূমি থেকে হিজরত করেছিলেন, বারবার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন। বারবার ঘুরে মক্কার পাহাড়ের দিকে, বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। নবিজির (সা.) এমন আচরণ থেকে মাতৃভূমির প্রতি তার গভীর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবিই প্রস্ফূটিত হয় এবং এই জীবন চিত্র থেকে দেশকে ভালোবাসার অমিয় শিক্ষা পাই আমরা। সুতরাং একজন খাঁটি মুসলিম হিসেবে, একজন মুমিন বান্দা হিসেবে হৃদয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা লালন করা উচিত। অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে, যার মাঝে দেশপ্রেম নেই, দেশ ও দেশের সম্পদ-সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, খাঁটি মুমিন তিনি নন।

নবিজি (সা.) বলেছেন, দেশপ্রেম তথা দেশকে ভালোবাসা ইমানের অঙ্গ। ইমানের মতো অপরিহার্য বিষয়ের অঙ্গ নির্ধারণ করার মধ্যে দিয়েই দেশপ্রেম তথা দেশকে ভালোবাসা গুরুত্ব অনুমান করা যায়। ইসলাম এ বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব প্রদান করেছে বলেই ইমানের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কেবল ইমানে অঙ্গ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি। আরো একধাপ এগিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জীবনদানকারী মানুষগুলোকে শহীদের মর্যাদা দান করেছে ইসলাম। দেশকে ভালোবেসে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে যারাই জীবন উৎসর্গ করবে ইসলাম তাদের শহীদের মর্যাদায় ভূষিত করেছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ইমানি দায়িত্ব। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশ রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে, দেশের উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে, তাদের জন্য হাদিসে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, একদিন এক রাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দেয়া অপেক্ষাও উত্তম। (মুসলিম)

হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ দেশপ্রেমী মানুষ। দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশকে প্রাধান্য দেয়া, দেশ ও দেশের মানুষকে সম্মান করাসহ দেশাত্ববোধকমূলক এমন কোনো ভালো গুণ নেই নবিজির (সা.) মাঝে যার সম্মিলন ঘটেনি। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষ ও সম্পদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নিজ হিজরত করেছেন কিন্তু দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কোনো অভিযোগ তোলেননি। দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেমের এমন উজ্জ্বল উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই বললেই চলে। তাই আমাদের সবার উচিত নবিজির (সা.) সঠিক অনুসারী হিসেবে দেশকে ভালোবাসা, দেশের সম্মান ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং খাঁটি দেশপ্রেমিক হওয়া চর্চা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে শুদ্ধ নিয়মে দেশকে ভালোবাসার তওফিক দান করুন। আমিন

যাদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা, তাদের কাছে আমরা ঋণী 
যাদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে তাদের রক্তের কাছে নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই ঋণী। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার বীরত্বের গৌরবোজ্জ্বল স্মরণীয় দিন। এই দিনে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের বাঁচার সাধ ছিল কিন্তু তারা একটা আলাদা দেশ, আলাদা জাতি ও সার্বভৌমত্বের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। বিজয় অতি আনন্দের কিন্তু এ আনন্দের মধ্যে আমাদের স্মরণ করতে হবে, এর পেছনে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস রয়েছে। দুনিয়ার এ জীবন মানুষের হায়াতি জীবন। হায়াতি জীবন অতি সংক্ষিপ্ত ও অল্প দিনের। পরকালীন জীবন চিরস্থায়ী জীবন। স্বাধীনতার যুদ্ধে এ দেশের লাখ লাখ জনতা ইহকালের হায়াতি জীবন ত্যাগ করে। তাদের এ ঋণ শোধ করার মতো নয়। আজ তাদের আমরা কিছুই দিতে পারব না। তবে আমরা তাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করতে পারি আল্লাহ যেন তাদের শহীদের মর্যাদা দিয়ে তাদের কবুল করে নেন।

যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদরা প্রাণ দিয়েছে, সে স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আজ আমাদের ওপর। আজ যদি যোগ্য নাগরিক তৈরি করে এ দেশের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করা না যায় তা হলে শহীদের সে ত্যাগ বৃথা যাবে। আল্লাহর প্রতি ভয় দেশ প্রেম সততা দিয়ে নিজেকে তৈরি করে বিশ্বের বুকে এ দেশের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করা সম্ভব। শুধু আনুষ্ঠানিকতা, আলোচনা কিংবা শুধু পতাকা উত্তোলন করে শহীদের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না বরং এর সঙ্গে সঙ্গে যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক তৈরি করে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন করে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করা যেতে পারে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য, বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের আলাদাভাবে পরিচিত করার জন্য, যারা যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন সেইসব শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাদের আত্মার শান্তির জন্য বিশেষভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি।

মাওলানা মিরাজ রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top