সকল মেনু

শিল্প-সাহিত্যে পরিভাষার রূপ ও ইতিহাস

সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিবেদক, ৫ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার নাম, তাদেরকে চিহ্নিতকরণের যে প্রক্রিয়া, তার প্রায় বেশিরভাগই ধারাটির উৎপত্তিস্থলের ভাষাতেই আমরা ব্যবহার করে আসছি। সেসব প্রচলিত বা অপ্রচলিত ধারার বাংলা রূপ কেমন, তার অর্থ কী, তার ব্যবহার, তার উদ্ভবের ইতিহাস, বিবর্তন এবং ব্যাপ্তি নিয়ে সাহিত্য পাতার চলমান আয়োজন ‘শিল্প-সাহিত্যে পরিভাষার রূপ ও তার ইতিহাস (পর্ব-১)’। এ পর্বে তুলে ধরা হলো অপেরা, মেলোড্রামা, মিসটিসিজম, সুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম এবং এক্সপ্রেশনিজম এর বাংলা রূপ ও এদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
অপেরা (Opera): বাংলায় এর অর্থ ‘গীতিনাট্য’। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘সুরে নাটিকা’। আধুনিক অপেরার জন্ম ষোড়শ শতকের শেষ দিকে। সপ্তদশ শতকে ইউরোপে অপেরা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই শতকের শেষ দিকে নেপলসের অপেরা দল সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ করেছিল। তখন অপেরার বিষয়বস্তু ছিল গ্রিক পুরাণ এবং প্রাচীন ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে অপেরার বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ফরাসি দেশে লঘু রসাত্মক কমিক অপেরা সৃষ্টি হয়, জার্মানিতেও সিরিয়াস অর্থাৎ গুরুগম্ভীর অপেরার সঙ্গে লঘু রসাত্মক অপেরার উপাদানের মিশ্রণ করা হয়। রোম্যান্টিক আন্দোলনের প্রভাবে অপেরার বিষয়বস্তু ও শিল্পরীতিতে যথেষ্ট অভিনবত্ব দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’ এবং ‘মায়ার খেলা’ অনেকাংশে পাশ্চাত্য অপেরার ধাঁচে লেখা হয়েছে।
 ‘গাথা অপেরা’ (Ballad Opera) অপেরার আর একটি রূপ। পুরনো কাহিনীনির্ভর অপেরা। ইংরেজি নাট্যকার গ্রে’র লেখা ‘বেগারস অপেরা’ (Beggar’s Opera, 1728)। বারলেট্টা গীতি প্রহসন থেকে উদ্ভূত হয় ‘অদ্ভূত নাট্য’ (Extravaganza)। বাংলায় এর প্রথম প্রবর্তন করেন জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধ্যানভঙ্গ)। গিরিশচন্দ্রের ‘আবু হোসেন’ । অপেরার কথাবার্তা সুরে বলা হয়। বাংলা অপেরা/গীতিনাট্যের ইতিহাসে আরও দুইটি উল্লেখযোগ্য নাম হলো- অতুলকৃষ্ণ মিত্র এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদন ‘আলিবাবা’, ‘বরুণা’ প্রভৃতি গীতিনাট্য একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
মেলোড্রামা (Melodrama) : বাংলায় এর অর্থ ‘অতিনাটক’। গ্রিক ‘মেলোস্‌’ শব্দের অর্থ গীত। অতিনাটক (মেলোড্রামা) আক্ষরিক অর্থে গীত ও নাটকের সমন্বয়। ষোড়শ শতকের ইতালিতে অপেরা আর অতিনাটকের উদ্ভব প্রায় একই সময় হয়। অষ্টাদশ শতকে ফরাসি নাট্যকারদের হাতে ‘মেলোড্রামা’ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই ধরনের নাটকে সংগীত, নাটকীয়তা, দৃশ্য ও বিষয়ের আবেগঘন উপস্থাপনা এবং মিলনাত্মক উপসংহারের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
 ‘অতিনাটকীয়’  (মেলোড্রামাটিক) নাটকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো- ঘটনার অপরিমিত প্রাধান্য ও বিস্তার, আবেগবাহুল্য, অতিশয়োক্তি, নাট্যকারের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ, বহিরঙ্গ দৃশ্যসজ্জার প্রাধান্য।  গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘প্রফুল্ল’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘মেবারপতন’ কিংবা ‘নূরজাহান’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা ও রানী’ নাটক অতিনাটকীয়তার উদাহরণ। রাজা বিক্রম ও রানী সুমিত্রার দাম্পত্য দ্বন্দ্বের আবেগ এই নাটকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য পেয়েছে।
মিসটিসিজম (Mysticism): বাংলায় ‘অতিন্দ্রীয়বাদ’ অথবা ‘মরমিয়বাদ’ হিসেবেই পরিচিত। ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন সম্ভব- এই মতবাদ; চিন্তা বা ভাবের অস্পষ্টতা। অতিন্দ্রীয়বাদী (মিসটিক) অর্থাৎ অতিন্দ্রীয়বাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’, এছাড়া চণ্ডিদাসের পদে, মিরাবাইয়ের ভজন এবং আউল-বাউলদের গানে অতিন্দ্রীয়বাদের আস্বাদ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা ও গদ্যরচনাতেও অতিন্দ্রীয়বাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
সুররিয়ালিজম (Surrealism): বাংলায় ‘অধিবাস্তববাদ’। যদিও ‘সুররিয়ালিজম’ শব্দটি ১৯১৭ সালে ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিন প্রথম ব্যবহার করেন, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে এই ‘সুররিয়ালিস্ট’ বা অধিবাস্তববাদী আন্দোলন শুরু করেন আঁদ্রে ব্রেতোঁ। ব্রেতোঁ ১৯২২ সালে দাদাবাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে রচনা করেন ‘ম্যানিফেসত দ্যু সুররিয়ালিজম’। বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াসকেই আপোলিন ‘সুররিয়ালিজম’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই জন্যই বাংলায় এটিকে ‘অধিবাস্তববাদ’ বলা হয়। যৌক্তিকতা এবং অযৌক্তিকতার মধ্যে সীমারেখা মুছে ফেলাই অধিবাস্তববাদী শিল্পীর কাজ। তার মতে, অন্তর্জগৎ, বহির্জগতের চেতন ও অবচেতনের মধ্যবর্তী কোনো সীমারেখা না থাকাই কাম্য। সাহিত্য ও শিল্পের জগতে স্বপ্ন ও কর্মের বাস্তবতা মেনে নিয়েছিলেন অধিবাস্তববাদীরা। যেমন ব্রেতোঁ ছিলেন স্বপ্ন ও কর্মের বাস্তবের বৈপরীত্যের পরিবর্তে এদের মিলনজাত একটি বিশুদ্ধ বাস্তবের সম্ভাব্যতায় বিশ্বাসী।
সাহিত্যের অপেক্ষায় শিল্পের ক্ষেত্রে এই আন্দোলন বেশি সফল হয়েছিল। শিরিকো, পিকাসো, তাঁগি এবং দালি এরা প্রত্যেকেই অধিবাস্তববাদী ছবি এঁকেছেন।
স্ট্রাকচারালিজম (Structuralism): বাংলায় একে বলে ‘অবয়ববাদ’ এবং ‘চিহ্নবিজ্ঞান’ (সেমিয়টিকস)। মূলত ফের্দিনাঁ দ্য সোসুর (১৮৫৭-১৯১৩) প্রণীত ভাষাতত্ত্ব, অংশত রুশ ফরমালিজম এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ভ্লাদিমির প্রপের ‘মরফলজি অব ফোক টেল’ (১৯২৮) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রহার ভাষাবিজ্ঞান সমিতির নিকোলাই ত্রুবেৎস্কয় ও রোমান ইয়াকবসন ভাষাবিশ্লেষণে অবয়ববাদী পদ্ধতির ভিত্তি তৈরি করেন। ১৯৬০ সালে ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ ক্লদ লেভিস্ত্রোসের মিথতত্ত্ব বিশ্লেষণের পর থেকেই এই তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ আরম্ভ হয়। অবয়ববাদী সমালোচনায় পাঠ্যবিষয়টি এক বস্তুনিষ্ঠ অবয়ব রূপে বিবেচনা করা হয়। অবয়ববাদীদের আলোচনার বিষয় প্রকাশিত রূপের সংগঠন। কোনও কিছুর সংগঠক উপাদানগুলোর স্বতন্ত্র আলোচনা নয় সমগ্রের ওপর ঝোঁক দিয়ে বিভিন্ন অংশের সম্পর্কসূত্রের পর্যালোচনাই হলো অবয়ববাদীর মূল কথা।
এক্সপ্রেশনিজম (Expressionism): বাংলায় একে অভিব্যক্তিবাদ’ বা ‘প্রকাশবাদ’ও বলা হয়। দৃশ্যশিল্পে ও সাহিত্যে বাস্তববাদের চরম বিরোধী এক প্রকাশভঙ্গি। শব্দটি সম্ভবত প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ভকস এল। জুলিয়ঁ অগস্ত হারভের আঁকা একগুচ্ছ চিত্রের শিরোনাম ছিল ‘এক্সপ্রেশনিজম’ (Expressionism)। এই নাম থেকেই শব্দটির উৎপত্তি। ১৯১০ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে জার্মানিতে চিত্রশিল্পে, নাটকে, কাব্যে, চলচ্চিত্রে এই অভিব্যক্তিবাদের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। আসকার কোকোশকা, কান্দিনস্কি প্রমুখ অভিব্যক্তিবাদী শিল্পীরা ভ্যান গগ এবং এডওয়ার্ড মানখ (Munch) দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের শিল্পকর্মে অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশভঙ্গি ব্যবহার করেন। যেমন দৃঢ় কৌণিক লাইনের ব্যবহার, অস্বাভাবিক রঙের প্রয়োগ ইত্যাদি।
অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে প্রায় সমসাময়িককালে উদ্ভূত ভবিষ্যবাদের সাদৃশ্য দেখা যায়। এর সঙ্গে অধিবাস্তববাদেরও (সুররিয়ালিজম) কিছু মিল আছে। স্ট্রিন্ডবার্গের ‘দ্য ড্রিম প্লে’ এবং ‘দ্য ঘোস্ট সোনাটা’ বিখ্যাত অভিব্যক্তিবাদী নাটক। মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ও’নিলের অভিব্যক্তিবাদী নাটক ‘দ্য হেয়ারি এপ’ এবং ‘ল্যাজারাস লাফস’ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অভিব্যক্তিবাদী নাট্যকার হিসেবে কাইজার এবং টলারও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্য, প্রতাপচন্দ্রের ‘আজব দেশ’ নাটকে অভিব্যক্তিবাদের উপাদান পাওয়া যায়।
মেটাল্যাংগুয়েজ (Metalanguage): বাংলায় একে ‘অধিভাষা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এর ভাব বলতে ভাষা সম্পর্কে আলোচনার জন্য ভাষার যে কোন ব্যাবহার। যেমন, শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা, যুক্তি ইত্যাদি। ব্যাকরণ ও তার পরিভাষা হল অধিভাষা। এক কথায়, ভাষা বিষয়ক ভাষাই অধিভাষা। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, সাহিত্য-সমালোচনা হলো সাহিত্যের অধিভাষা।

অ্যালিটারেশন (Alliteration): বাংলায় একে অনুপ্রাস বলা যায়। একই শব্দ, সাধারণত প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণের পুনরাবৃত্তি। (‘ঝঞ্ঝার ঝংকারে ঝংকারে’ অথবা ‘গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে, গরজে গগনে’ অথবা ‘কেতকী কেশরে কেশপাশ করো সুরভি’) ইংরেজি অ্যালিটারেশন কবিতায় ছন্দ নয়, অনুপ্রাসই কবিতার সুত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনুপ্রাসিক ছন্দ (alliterative metre): মধ্যযতি (Caesura) দ্বারা দুটি অর্ধছত্রে বিভক্ত একটি দীর্ঘ বাক্য। প্রতিটি অর্ধছত্রে কয়েকটি ঝোঁক দেওয়া এবং একটি পরিবর্তনীয় (Variable) ঝোঁক না দেওয়া দল (সিলেবল)  থাকে। এই দুটি অর্ধছত্রকে অনুপ্রাস দ্বারা যুক্ত করা হয়। সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথের মতে স্বরবর্ণের বারবার বিন্যাসের ফলেই অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় না। তার মতে ‘রসের অনুগতভাবে বর্ণের প্রকৃষ্ট ন্যাস বা প্রয়োগেই অনুপ্রাসের সার্থকতা’

ডেকেডেনস (Decadence): ডেকেডেনসের বাংলা অর্থ ‘অবক্ষয়’। সাধারণ অর্থে ‘অবক্ষয়’ শব্দটি শিল্প ও সাহিত্যে এমন এক যুগ অথবা ক্রান্তিকাল সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেটি অব্যবহিত পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় নীতিগতভাবে অবক্ষয়ী। বিশেষ অর্থে শব্দটি বোঝায় শিল্প-সাহিত্যে অবক্ষয়ের আন্দোলন যেটি শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি দেশে। এই আন্দোলনের প্রবক্তারা ‘ল দেকাঁদ’ (Le Décadent) ১৮৮৬ নামে একটি মুখপত্র প্রকাশ করেছিলেন। শিল্পের স্বাতন্ত্র্য, শিল্পীর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা ও সমাজ সম্বন্ধে উদাসীনতা, প্রকৃতির চেয়ে কৌশলের প্রাধান্য, নবতর অনুভূতির সন্ধান—অবক্ষয় আন্দোলনের এইসব বিশিষ্টের সঙে কলাকৈবল্যবাদের বিশেষ যোগ ছিল।

অবক্ষয়ের আর একটি বৈশিষ্ট ছিল শতাব্দীশেষের অসুস্থতা। ফরাসি লেখক তেওফিল গোতিয়ের এবং আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালান পো-র ১৮৩০ এর দশকে লেখা থেকে এর শুরু। এর চূড়ান্ত রূপ শার্ল বোদলেয়ারের ‘লে ফ্র্যর দ্য মাল’ (Les Fleurs du mal, ১৯৫৭) কাব্যগ্রন্থে। ১৮৮০র এবং ৯০এর দশকে শতাব্দীশেষের সংস্কৃতিতে প্রকৃতির সর্বাত্মক বিরোধিতাই ছিল গোতিয়ে ও বোদলেয়ারের কথিত অবক্ষয় আন্দোলনের মুল কথা। ইংল্যান্ডে এর প্রথম প্রবর্তক জর্জ মুর (কনফেনশনস অব আ ইয়াং ম্যান, ১৮৮২)। আরথার সাইমনস তার এক নিবন্ধে (দ্য ডেকেডেন্ট মুভমেন্ট ইন লিটারেচার) ‘অবক্ষয়’কে এক অদ্ভুত অসুখ বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, অতিবিলাসী সভ্যতা, তীব্র আত্মসচেতনতা, কৃত্রিম ও চূড়ান্ত পরিশীলন এবং মানসিক ও নৈতিক বিকৃতি থেকেই ‘অবক্ষয়ে’র জন্ম। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘সংবর্ত’ কাব্যের মধ্যে অবক্ষয়ের স্বর শোনা যায়। এছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন’ ও ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাস, লোকনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাবুঘাটের কুমীর মাছ’, সমরেশ বসুর ‘বিবর’, জীবনানন্দ দাশের ‘জীবনপ্রণালী’ উপন্যাস ও ‘নিরুপম যাত্রা’ গল্পে অবক্ষয়বাদ উঁকি দেয়।

ডিকনস্ট্রাকশন (Deconstruction): ডিকনস্ট্রাকশন এর বাংলা হচ্ছে অবিনির্মাণ। ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা প্রথম এই শব্দটি ব্যাবহার করেন। প্রাথমিক ভাবে শব্দটি এক বিশেষ ধরনের সাহিত্য-সমালোচনার-পদ্ধতি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে এই দর্শনসঙ্ক্রান্ত দেরিদার লেখা বিভিন্ন আকরগ্রন্থের প্রকাশের সঙে সঙেই এই ধারণার প্রবর্তন হয়। দেরিদার দুজন প্রখ্যাত সমালোচক ইয়েলের জে. হিলিস মিলার এবং পল দ্য মান এই সমালোচনা পদ্ধতি ব্যবহার করেন। দেরিদার মতে পাশ্চাত্য দর্শনে অস্তিত্বের আধিদৈবিক বিষয়টি নিহিত থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, লিখিত শব্দের বিপদজনক দ্ব্যর্থ ব্যঞ্জনার মধ্যে না গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে কথিত শব্দের মধ্যে দিয়ে ধ্রুব সত্য বা আপেক্ষিক সত্য বা কোন বিশেষ অর্থ বা সারবস্তু অথবা কেন্দ্রীয় বিষয়ের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। [ডিকনস্ট্রাকশন বিষয়ে বিস্তারিত: জ্যাক দেরিদার ভাষাদর্শন]

ইমপ্রেশনিজম (Empresyonizm): বাংলায় ভাবপ্রেক্ষনবাদ। সাধারণ অর্থে সাহিত্যকর্মের এমন এক বৈশিষ্ট্য যেখানে বস্তুনিষ্ঠ জগতের উপর জোর না দিয়ে বিষয় সম্পর্কে লেখক বা শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভব ইম্প্রেশনের উপর জোর দেওয়া হয়। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসি চিত্রকলার এক বিশেষ প্রকাশরীতি থেকেই এই শব্দটির উদ্ভব। সম্ভবত শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৭৮ সালে প্যরিসে প্রথম প্রদর্শিত ফরাসি শিল্পী ক্লদ মোনের ছবি ‘ইমপ্রেসিও’ সলেইল লভোর আলোচনা প্রসঙ্গে। মোনে ও রনোয়ার মতে চিত্রশিল্পীরা শিল্পে আলকের বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময় দেখতে চেয়েছিলেন যে একই বিষয়ে কীভাবে দর্শকের কাছে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপে প্রতিভাত হতে পারে। সত্য নিহিত থাকে মানসিক অবস্থায়, বাহ্যিক জগতের চিত্রায়নে নয়—এই ছিল ইমপ্রেশনিজমের মুল বক্তব্য।

সাহিত্যে এই শব্দটি ব্যাপক অর্থে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বহু ফরাসি প্রতীকবাদ কবিকেই ইমপ্রেশনিস্ট আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডে নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় ওয়ালটার পেটার শব্দটি তার ‘দ্য রেনেসাঁস’-এ ব্যাবহার করেছেন। তার মতে যে সমালোচক শিল্প বিচারে নিজস্ব পক্রিয়াটিই মূলত অনুধাবন করেন তিনিই ইমপ্রেশনিস্টিক সমালোচক। ইমপ্রেশনিজমের অপর এক প্রবক্তা আরথার সাইমনস, তার মতে কবিতায় ইমপ্রেশনিস্টরা তাদের অভিজ্ঞতার পতিক্রিয়া বিধৃত করে থাকেন, অভিজ্ঞতা নয়। আধুনিক উপন্যাসে এই কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখানে ‘ইমপ্রেশনিজম’ বলতে বোঝায় কোন চরিত্রের অন্তজীবনের অন্তরঙ্গ চিত্রায়ন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top