সকল মেনু

জাহাজ ভাঙায় বিনিয়োগে ২০ ব্যাংক দিশেহারা

ঢাকা, ৪ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : জাহাজ ভাঙা শিল্প এখন ভাঙছে দেশের ব্যাংকিং খাতকে। ইতিমধ্যে ঝুঁকিতে পড়ে গেছে ব্যাংকের প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ। ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে। অনেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করার ভয়ে তাদের কার্যালয়ও গুটিয়ে ফেলেছেন। অনেকে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেও ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এতে করে টাকা ফেরত না পাওয়ার আশংকায় অন্তত ২০টি ব্যাংক এখন দিশেহারা।

এসব ঘটনা ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। এতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের নতুন ঋণ অনুমোদনে আস্থা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্ট ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় গড়ে ওঠা জাহাজ ভাঙা শিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র মতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর একটা বড় অংশ রয়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে।

বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাকি দেড় হাজার কোটি টাকা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাস্টার আবুল কাসেম যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক মন্দা ও সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় লোহার চাহিদা কমে যাওয়ায় এ শিল্প সংকটে পড়েছে। এ শিল্পের অধিকাংশ উদ্যোক্তা খেলাপি হয়ে পড়েছেন। ব্যাংক থেকে নেয়া টাকা ফেরত না দিতে পারায় কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেন, দুই বছর আগে ১২৫টিরও বেশি ইয়ার্ড চালু ছিল। এখন তা ৪৫টিতে নেমে এসেছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আর বন্ধ হয়ে যাওয়া অধিকাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, এ খাতের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগ ব্যাংকের। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কোনো মর্টগেজও নেয়নি। শুধু বিশ্বাসের ওপর এ খাতের উদ্যোক্তাদের টাকা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও পূবালী ব্য্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, পূবালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে এখনও কেউ পালায়নি। তবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জাহাজ ভাঙা শিল্পে আটকা পড়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে আরও সহনশীল হতে হবে। একইভাবে জাহাজ ভাঙা শিল্পের ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের খেলাপি করা ব্যাংকের উদ্দেশ্য নয়। যেহেতু ব্যাংকগুলো বিশ্বাস করে ঋণ দিয়েছে, সেহেতু এ খাতের উদ্যোক্তাদের সেই বিশ্বাস রক্ষা করতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যে সুযোগ দিয়েছে তার সুযোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। সূত্রে জানা যায়, ৬০-এর দশকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট সমুদ্র উপকূলে ঝড়ে আটকে যাওয়া জাহাজ কুইন আল পাইন ভেঙে স্থানীয় কয়েকজন পুঁজিপতি এখানে জাহাজ ভাঙা শিল্পের সূচনা করেন। তারপর এ ব্যবসায় প্রচুর লাভের কথা বিবেচনা করে ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলতে থাকে শিপইয়ার্ড। ফলে দুই দশক অর্থাৎ ৮০-এর দশকের মধ্যে উপজেলার ফৌজদারহাট থেকে বার আউলিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প। এরপর থেকে ব্যাংকগুলোও বেশি মুনাফার আশায় বন্ধকি ছাড়াই এ শিল্প অর্থায়ন করে। এ অর্থায়নই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকের জন্য। শুধু সীতাকুণ্ড এলাকায় গড়ে ওঠা অর্ধেকেরও বেশি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে গত এক বছরে। এ কারণে একের পর এক খেলাপি হয়ে পড়ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

ব্যাংকের মামলা : এ দিকে ১৩ ফেব্র“য়ারি সীতাকুণ্ড থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে ব্যাংক এশিয়া। এর আগে ২০১৩ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্পের ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মুহিব স্টিল অ্যান্ড শিপ রিসাইক্লিংয়ের বিরুদ্ধে অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১১২ কোটি টাকা, চিটাগাং ইস্পাত লিমিটেডের বিরুদ্ধে অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি শাখা, পূবালী ব্যাংক সিডিএ শাখা ও ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ১২৪ কোটি, ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৬০ কোটি, আহমেদ মুজতবা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের এনসিসি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ও ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ৬৩ কোটি, এসএম স্টিল গ্যালভানাইজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ৪৩ কোটি, কিউএস স্টিলের ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৩২ কোটি, সাকিব স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের ঢাকা ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখা ৩১ কোটি, এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ১৯ কোটি, আবরার স্টিলের ব্যাংক এশিয়া আগ্রাবাদ শাখা ১৬ কোটি ও আলভি স্টিল এন্টারপ্রাইজের ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৯১৫ টাকা আদায়ে মামলা হয়েছে।

আমেরিকায় পলায়ন : শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী মোঃ গিয়াস উদ্দিন কুস–মের বিরুদ্ধে ১৩ ফেব্র“য়ারি মামলা করেছে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ভাটিয়ারী শাখা। ভাটিয়ারী শাখার সিনিয়র অফিসার মোঃ এমরানুল হক বাদী হয়ে এ মামলা করেন। তবে ১২ ফেব্র“য়ারি গিয়াস উদ্দিন সপরিবারে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার পরই এই মামলা হয়েছে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী মোঃ গিয়াস উদ্দিন কুসুম ২০১০ সালের ১৫ জুন থেকে তাদের শাখায় লেনদেন শুরু করেন। প্রথমে তিনি ওই শাখা থেকে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকার এলসি, ১০ কোটি টাকার এলটিআর ও ২ কোটি টাকার ওডি ঋণ নেন। পরবর্তীকালে ব্যাংকের সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ১০১ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৩৭৬ টাকা ঋণ নেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ হেফাজেতুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আগে ব্যাংক থেকে ঋণ চাইলে ব্যাংক ঋণ দিত। কোনো মর্টগেজ লাগত না। কিন্তু ব্যাংক এখন আর বিশ্বাস করতে চায় না। তারা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তিনি বলেন, কুসুম পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ব্যাংকগুলো আমাদের অবিশ্বাস শুরু করেছে। এছাড়া নানা কারণে জাহাজ ভাঙা শিল্প আজ হুমকির মুখে। বর্তমানে ৭০টির মতো ইয়ার্ড খোলা রয়েছে। শতাধিক বন্ধ হয়ে গেছে।

ভুয়া ঠিকানা : চট্টগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদের নূর চেম্বারের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে মুহিব, সাকিব ও আহমেদ মুজতবা স্টিলের। এর মধ্যে মুহিব স্টিল ও সাকিব স্টিলের স্বত্বাধিকারী হিসেবে নাম রয়েছে মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের। আহমেদ মুজতবা স্টিলের স্বত্বাধিকারী হিসেবে রয়েছে তার ভাই মুজিবুর রহমান মিলনের নাম। এছাড়াও বি রহমান শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ ও সিলভা শিপব্রেকিং লিমিটেডের ঠিকানাও একই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, নূর চেম্বারে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই নেই। এ প্রসঙ্গে নূর চেম্বারের তত্ত্বাবধায়ক রহমত উল্লাহ জানান, ভবনটিতে এসব নামে কোনো প্রতিষ্ঠান কখনও ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ ফাঁকি দিতে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি কিছু ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীর কারণে জাহাজ ভাঙা শিল্প আজ সংকটের মুখে পড়েছে। এখন সব ইয়ার্ড লোকসানে পড়েছে। ব্যাংকগুলো এ শিল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) আবার তোড়জোড় শুরু করেছে। যার কারণে জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধ হওয়ার পথে। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা নেই এমন ব্যবসায়ীকে সদস্য করার কারণে এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। ব্যাংকের টাকা নিয়ে গিয়াস উদ্দিন কুসুমের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি লজ্জাজনক ঘটনা বলেও মনে করেন তিনি। জানা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ও কুমিরার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১৮০টি জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান ছিল। ব্যবসায়িক মন্দায় চার-পাঁচ বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ৪৫টির মতো ইয়ার্ড খোলা। তবে কাজ চলছে মাত্র ৮-১০টিতে। বর্তমানে আমদানি করা জাহাজ ইয়ার্ডে এনে ভাঙা পর্যন্ত প্রতি টনে খরচ পড়ে ৪১-৪২ হাজার টাকা। আর জাহাজ ভাঙা প্লেটের বাজারমূল্য প্রতি টন সাড়ে ৩১ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি টন ইস্পাতে প্রায় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, জাহাজ ভাঙা শিল্পের নামে ব্যাংকগুলো কোনো রকম বাছ-বিচার ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। কে ব্যবসায়ী আর কে ব্যবসায়ী নয়, তা দেখেনি। এখন ব্যাংক দেখতে পাচ্ছে অব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে কি ভুলটাই না করেছে।(যুগান্তর)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top