সকল মেনু

শারমিন আকতার এর ছোট গল্প:নিমন্ত্রণ

 শানজানা জামান, ঢাকা, ৪ জানুয়ারি :  শহরের সবচেয়ে বড় চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ঝিয়াং-এ যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কয়েকদিন আগে। মাধ্যমটা ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে। কনে দেখার অনুষ্ঠান। ফুফাতো ভাই তার বউ দেখার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে যায়।

আমাদের ফ্যামিলিতে বলতে গেলে এ ফুফাতো ভাইটাই বেশি শিক্ষিত। ওর পরে শিক্ষিত ছেলে হিসাবে বংশে বেশ সম্মানজনক স্থান পেয়েছি আমি। এম.এ. পাশ করেছি যে। সে কারণেই চাকুরী না হলেও আমাদের ফ্যামিলিতে বেশ মর্যাদা পাই। ঠিক একই কারণে শহুরে হালচাল, বিশেষ করে ঢাকা শহরের হালচাল না বুঝলেও তার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগটা পেয়ে গিয়েছিলাম অনায়াসেই।

ছোট ফুফুর একমাত্র ছেলে সে। বড় ফুফুর পাঁচ ছেলের মধ্যে অধিকাংশই সাচ্চা কিষাণ। বড় চাচার দুই ছেলে। তাদের কেউ সেভাবে পড়াশুনা করে নাই। টেনে-টুনে এস.এস.সি পাশ করার পর একজন বাজারে কাপড়ের দোকান দিয়েছে। আরেকজন একটা পাওয়ার টিলার কিনে জমিতে চাষ করে আয় রোজগার করে। দুজনেই বিয়ে করেছে। দুজনেরই বউ খুব সুন্দরী! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।

আমার ফুফাতো ভাই যার বউ দেখতে গিয়েছিলাম, সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বুয়েট থেকে পাশ করেছে গত বছর। পাশ করার পর বিরাট বেতনের চাকু পেয়ে গেছে। তাই বিয়ের তোড়জোড়টাও তাড়াতাড়ি। আমার চেয়ে বয়সে ও প্রায় তিন বছরের ছোট । কিন্তু চাকুরী আগে হওয়াই বিয়ের সানাই বেজে গেল আগেই । আমি তো নিতান্ত এক হতভাগা; সানাইয়ের সুর শুনতে বহু দেরি আছে। তাছাড়া এদেশে এমনই হয়। কার বয়স কম, কার বেশি এই ভিত্তিতে বিয়ে হয় না। হয় ছেলের আয়-রোজগারের ওপর।

যে যতো তাড়াতাড়ি ইনকাম করা শুরু করে; তার বিয়ের সানাইও বাজে ততো তাড়াতাড়ি। বয়স ষোলই হোক, আর ছত্রিশই হোক; সেটা ফ্যাক্টর না। শহরে ছেলেদের দাড়ি মোছ গঁজালে যখন তারা লজ্জায় বাথরুমের দরজা লাগিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বড় বোনের ফেসওয়াশ দিয়ে সেভ করে; গ্রামের অনেক ছেলেই তখন সানাই বাজিয়ে হাজার লোকের সামনে বউয়ের সঙ্গে মালা বদল করে। বিয়ের মাধ্যমেই নিজের সদ্য প্রাপ্ত পৌরুষত্ব্যের জানান দেয়। এখানেও সেই নিয়ম। সে ইনকাম করে। পাশের বাসায় মণ্ডলের ধান খেতে পাওয়ার টিলার চালায়, মাছ মেরে বাজারে মাছ বিক্রি করে। অথবা রাস্তার ধারে একটা নিজস্ব পানের দোকান আছে তার।

এবার নিজের কথায় আসি। বিয়ে শাদি তো হল না। তাই ফুফাতো ভাইয়ের হবু বউ দেখতে গেলাম। অন্যের বউ দেখে নিজের চোখ জুড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি! সে উদ্দেশ্যে গায়ে জড়ালাম সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। গলায় ঝুলালাম সাহেবি নীল টাই। ইনকাম না থাকলেও এমন ভাব নিলাম যেন কোনো  মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির জি.এম.। মুখে সাহেবি গাম্ভীর্য মেখে ভাবের দোলায় দুলতে দুলতে ছুটলাম ঝিয়াং-এর দিকে। বেশ দাপুটে ভাব নিয়ে প্রবেশ করি ভেতরে। হঠাৎ একজন আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় ডাকলো,
এই ভাই এই দিকে আসুন তো। তাড়াতাড়ি করুন। সবাই এসে পড়লো।

আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। কেন আমার সঙ্গে আদেশের সুরে কথা বলছে লোকটা? আমাকে কিই বা তাড়াতাড়ি করতে বলছে?

আগন্তুক লোকটার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের ঠাঁট বজায় রেখে যথারীতি ঝিয়াং এর আরও
ভেতরে ঢুকলাম সাহেবি ভঙ্গিতে। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। সেও আমার মতো সার্ট, প্যান্ট পরে গলায় একটা টাই ঝুলিয়েছে । আমাকে এক পলক দেখে কেমন যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে বলল,
–    আপনি এসব কি পরেছেন ভাইজান?

নিজের ইন করা শার্টের দিকে একবার তাকিয়ে হালকা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম
–    কেন? কি হয়েছে?
আমার কেন এর কোনো উত্তর দিল না ও । শুধু আশাহত মানুষের মতো চুপসে গিয়ে বলল
–    ভাইজান আপনি একটু বসুন । আমি ভেতর থেকে আসছি ।

ও  চলে গেলে অসহায়ের মতো একটা টেবিলের কোণে এসে বসি । একটু পরেই দেখি আমার মতোই সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট ও নীল টাই পরা সাহেবি বাবুরা খাবারের ট্রে, প্লেট, পানির বোতল নিয়ে ছুটোছুটি করছে…।
ওদের দেখে চমকে ওঠি । একি ওয়েটার কেন এই ড্রেসে? লজ্জায় মাথা নিচু করি । একবার আড় চোখে রেস্টুরেন্টে আসা ভদ্র লোকগুলোর দিকে তাকালাম । কেউ আমাকে দেখছে কিনা তা আঁচ করতে । হ্যাঁ একজন আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আর তার পাশে বসে থাকা আরেক ভদ্র লোক হাত বাড়িয়ে ডাকছে আমাকে
–    ব্রাদার এদিকে… ।
অন্য দিক থেকে আরেকজন বলল,
–    এই বয়! এই দিকে আসো । ওই ভাবে বসে আছো কেন ?
এমনকি রেস্টুরেন্টের একটা ওয়েটার পর্যন্ত কাছে এসে বলল
–    ভাই! এভাবে বাবু হয়ে বসে থাকলে হবে? হাত লাগান ।
সে আমার হাতে এক গাদা প্লেট তুলে দিল! এরপর এক টুকরো মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল
–    ব্রাদার একটু সার্ভ করুন না প্লিজ । মনে হয় আজকে নতুন জয়েন্ট করেছেন ।

আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দৌড়ে চলে গেল পাশের টেবিলে তাদের কিছু লাগবে কিনা জানতে…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top