সকল মেনু

লালচাঁন পীর থেকে ঈমাম মাহাদির সেনাপতি

টাঙ্গাইল, ২৫ ডিসেম্বর : গত শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গোপীবাগে তিন জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চচল্যের সৃষ্টি হয়।

এ হত্যাকাণ্ডের শিকার ছয় জন হলেন- পীর লুৎফোর রহমান, তার বড় ছেলে সরোয়ারুল ইসলাম ফারুক, খাদেম মঞ্জুরুল, মুরিদ রাসেল, শাহীন ও মজিবর।

ঢাকার গোপীবাগে পীর লুৎফোরের ভাড়া বাসায় তাদের জবাই করে হত্যা করে দুষ্কৃতকারীরা।

কিন্তু এত বড় হত্যাকাণ্ডের বিষাদ ছাপিয়ে সামনে চলে আসে কতগুলো প্রশ্ন। কেন এ হত্যাকাণ্ড? যারা খুন হলেন, কী তাদের পরিচয়? আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ও গোয়েন্দারা তাদের সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানতেন না কেন? এরকম অনেক কৌতূহলী প্রশ্ন এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে।

তবে এর মধ্যে যে লোকটির মৃত্যু আলোড়ন তুলেছে তিনি হলেন পীর লুৎফোর রহমান। রহস্যঘেরা এক মানুষ তিনি। এরই মধ্যে তাকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক লেখা-লেখি, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু ধোয়াশা যেন কাটছেই না। পীর লুৎফোরের অনেক কাহিনী এখনও অজানা।

সরেজমিনে ঘুরে ও লুৎফোরের পক্ষে-বিপক্ষের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে অজানা তথ্যগুলো জানার চেষ্টা করা হয়েছে। অনুসন্ধান করা হয়েছে নিহত পীরের কাজ-কর্মের ওপর।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানা গেছে, প্রচলিত ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন এই লুৎফর। নিজেকে তিনি ঈমাম মাহাদির প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করেন। হয়ে পড়েন স্বঘোষিত পীর। এরপর শুরু হয় মুরিদ জোগাড়ের কাজ। মাত্র কয়েক বছরে হাজার হাজার মুরিদও জুটে যায় তার।

বিভিন্ন অপরাধ আর মামলায় একাধিক বার গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই কথিত পীর।

তবে তাকে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো। তার এই নির্মম মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন তার ভক্তকুল। পীর লুৎফোরের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী ও টাঙ্গাইল-জামালপুর সীমান্তের প্রতন্ত্য চরাঞ্চল চড়ভড়ুয়া গ্রামের আত্মীয় আর প্রতিবেশীরা সহজেই মেনে নিতে পারেননি তার মৃত্যু। তাদের শোকাহত অনুভূতি রাইজিংবিডির অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।

চরভড়ুয়া থেকে ঢাকার গোপীবাগ। এ হলো পীর লুৎফোরের স্থানিক উত্থান। আর মর্যাদার উত্থান ঘটে- ‘লালচাঁন পীর থেকে ঈমাম মাহাদির সেনাপতি’ হিসেবে।

এর পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস। যমুনা নদীর তীরবর্তী টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত চরাঞ্চল ভূয়াপুর উপজেলার অর্জুনা ইউনিয়নের
চরভড়ুয়া গ্রামে লুৎফোর রহমানের জন্ম। এলাকার মানুষ তাকে লালচাঁন নামে ডাকে। লালচাঁনের বাবা হোসেন আলী জোয়াদ্দার (মৃত)। একান্নবর্তী সংসারে তিন ভাই ও চার বোনরে মধ্যে লুৎফোর রহমান ছিলেন পঞ্চম।

ছোটবেলা থেকেই লুৎফর ছিলেন ধার্মিক আর শান্ত প্রকৃতির। ইসলামের কঠোর অনুসারী ছিলেন। শিশু লুৎফোর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। স্থানীয় চরভড়ুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে গোপালপুরের পিংনা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এসএসসি ও ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পাস করেন।

এর আগে ১৯৭৬ সালে সেনাবাহিনীতে ক্লার্ক পদে যোগদান করেন। বগুড়ার রাজেন্দ্রপুরে ছিল তার কর্মস্থল। চাকরি করা অবস্থায় ১৯৮০ সালে গোপালপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। এরপর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮১ সাল। হঠাৎ করেই সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। ফিরে যান গ্রামের বাড়ি। ধর্মভক্ত লুৎফোরের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। ইসলামের প্রচলিত আচার-আচরণ ও বিধি-বিধানে তিনি আস্থাহীন হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তার আচরণ ধরা পড়তে থাকে মানুষের কাছে। তবে ধর্মহীনতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হওয়ায় এ নিয়ে তখন খুব বেশি বিপাকে পড়তে হয়নি তাকে।

এমন পরিস্থিতিতে জীবন পথে আবারও বাঁক নেন লুৎফোর। বাড়ি ফেরার আট বছর পরের কথা। ১৯৮৯ সাল। আচমকাই চলে আসেন ঢাকায়। চাকরি নেন ঈগল কোম্পানিতে। মোটা মাইনে, প্রায় ৭০ হাজার টাকা।

এর দুই বছর পর ১৯৯১ সালে ঈগল কোম্পানির কাজ ছেড়ে মেটলার কোম্পানিতে যোগ দেন। বেতন আগের চেয়ে বেশি। মেটলারে কাজ করেন আট বছর।

১৯৯৯ সাল। মনস্থির করেন কোম্পানির কাজ আর করবেন না। নিজেই ব্যবসা-ট্যাপসা কিছু একটা দাঁড় করাবেন। শুরু করেন বায়িং হাউজের ব্যবসা। কিন্তু তাতেও বেশি দিন তার মন টেকেনি। অবশ্য ব্যবসায় তিনি লাভ করেছিলেন না লোকসান করেছিলেন, এ ব্যাপারটি পরিষ্কার জানা যায়নি।

আবারও নাটকীয় মোড়। ব্যবসাকে সালাম জানিয়ে ফিরে যান গ্রামের বাড়ি। তবে এবার যে লুৎফোর গ্রামে ফিরে গেলেন তিনি একেবারে অন্য মানুষ। কারও সঙ্গে তার চিন্ত-ভাবনা, আচার-আচরণের মিল নেই। দিন দিন নতুন এক লুৎফোরকে আবিষ্কার করতে থাকেন গ্রামের মানুষ।

তার গোমর নিজেই কিছুটা খুলে দেন লুৎফোর। হঠাৎ একদিন পরিবারকে জানান, তিনি জামালপুরের সরিষাবাড়ীর সুজাত আলী নামে এক পীরের মুরিদ হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই পীর কিছু দিন পর মারা যান। পীরের ছেলে পীর হবে- এমন ধারণা থাকলেও ওই পীরের ছেলে সিরাজগঞ্জের নাটিয়াপাড়ার কাজিপুর  গ্রামের মাওলানা মোহাম্মদ শামসুল হক তিরবীজ নামে আরেক পীরের মুরিদ হন। লুৎফোরের বড় ভাই ফরমান আলী জোয়ারদারের কাছ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। লুৎফোরও সম্ভবত সেই পীরের মুরিদ হন।

তবে পীর ছেড়ে পীর ধরলে কি হবে! লৎফোর যখন ঢাকায় চাকরি করতে তখন-ই নাকি তিনি স্বপ্নে ঈমাম মাহাদির দেখা পেয়েছেন! মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তিনি তা প্রচারও করতেন।

গ্রামবাসীকে লুৎফোর বলতেন, রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় ইমাম মাহদির জন্ম হয়েছিল এবং তিনি মারাও গেছেন। ঈমাম মাহাদি মৃত্যুর আগে তাকে তার প্রধান সেনাপতি মনসুরের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। সেনাপতি মনসুর নামে পরিচিত হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন।

এ সময় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে এলাকার জনগনকে নতুন নতুন ধারণা দিতে থাকেন তিনি। তার ধারণাকে ‘মনগড়া’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন গ্রামের লোকজন। সে সময় হাতে গোনা দুই-একজন ছাড়া পুরো এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে চলে যায়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। গ্রামের মানুষ বরাবরই তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু থেমে থাকেনি লুৎফোরের অভীপ্সা পূরণের চেষ্টা।

১৯৯৭ সাল। হিজবুল মাহাদি বা ঈমাম মাহাদির দল নামে একটি নতুন সংগঠনের ঘোষণা দেন লুৎফোর। এলাকাবাসীর দাবি, এর মাধ্যমে তার ভণ্ডামি চরমে পৌঁছে যায়। ডাকনাম লালচাঁনের সঙ্গে ‘পীর’ শব্দটি যুক্ত হয়ে তার নতুন নাম হয় লালচাঁন পীর। ধর্ম নিয়ে নয়া পীর লালচাঁনের বিতর্কিত কাজ-কর্মে অতিষ্ঠ হয়ে ওই বছরের নভেম্বরে গ্রামবাসী তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

ইসলাম ধর্ম বিকৃত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ধর্মের বিকৃত প্রচারণার দায়ে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। লোকলজ্জার ভয়ে বোরকা পরে চলে আসেন ঢাকায়।

ঢাকার গেন্ডারিয়ায় নতুন আস্তানা গাড়েন। সেখানেই ১৯৯৯ সাল থেকে লুৎফর রহমান লিফলেট বিতরণসহ লিখিতভাবে হিজবুল মাহাদি নামের সংগঠনের জন্য প্রচার শুরু করেন। তখন কিছু লোকজন তার মুরিদ হলেও তা ছিল হাতেগোনা।

কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামের সঙ্গে জুড়ে দেন ফারুক। বড় ছেলে সারোয়ারুল ইসলাম ফারুক ও মেয়ে শামসুন্নাহার ফারুক পড়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক পড়েছেন নটরডেম কলেজে। সন্তানদেরকেও তিনি নিজ আদর্শের অনুসারী করে কাছে রাখতেন। মুত্যুর আগ পর্যন্ত নিজ সন্তানদের তিনি ইমাম মাহাদির আদর্শ প্রচারের কথা বলে এসেছেন।

লুৎফেরের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে জানা গেছে, ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি সূত্রাপুর থানার দীননাথ সেন রোডের সাধনার গলিতে বাসা ভাড়া নিয়ে ‘হিজবুল মাহদী’ নামের সংগঠনের কাজ করতে থাকলে এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তখন লুৎফোরের সমর্থকরা আল্লাহকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করতে প্ররোচিত করছিলেন। গোটা বিশেক ভক্ত নিয়ে নিজ বাসায় নামাজ আদায় এবং জিকির করতেন তিনি।

লুৎফোর তার ভক্তদের বলতেন, ‘ইসলাম ধর্মের আলেমরা দাজ্জাল। তারা ঈমাম মাহাদিকে অনুসরণ করে না। কিন্তু ইমাম মাহাদিকে গ্রহণ না করে কেউ ইমান নিয়ে মরতে পারবে না।’

২০০৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লুৎফোরকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সূত্রাপুর এলাকায় এ কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তখন বেশ কিছুদিন জেল খাটেন তিনি। জেল থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বিরিব বাগিচায় আস্তানা গড়ে একই কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন। পরে এলাকার লোকজন তাকে গণধোলাই দিয়ে বের করে দেয়।

এরপর তিনি গোপীবাগে বাসা নিয়ে একই কাজ করতে থাকেন। নিজেকে কখনও ‘ইমাম মাহাদি’ আবার কখনও মাহাদির ‘সেনাপতি’ পরিচয় দিয়ে লুৎফর রহমান বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির রোষানলে পড়েন।

এরই ধারাবাহিকতায় দুই দফা গণপিটুনি ও হামলার শিকার হন তিনি। ৬০ বছরের জীবনে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন চার বার। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা ও জিডি রয়েছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই বছরের ১৪ অক্টোবর গোপীবাগের প্রথম লেনের একটি বাড়ি থেকে লুৎফর রহমানকে পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত শনিবার নিহত হওয়া মুরিদ মজিবর ও শাহীনও সে সময় গ্রেফতার হয়েছিল।

জানা যায়, ভক্তদের কাছে ‘আব্বা হুজুর’ নামে পরিচিত লুৎফোর ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে নানা অভিনব প্রন্থার কথা প্রচার করতেন। রুকু-সেজদা ছাড়া নামাজ পড়তেন তিনি। তাও দিনে মাত্র দুই ওয়াক্ত। সকাল ছয়টায়, সন্ধ্যায়। তবে তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করতেন তিনি। ঈদের নামাজ ও জুমার নামাজ পড়তেন না তিনি। কিন্তু সপ্তাহে শুক্রবার এবং সোমবার মজমা আকারে নামাজ পড়তেন। মুখোমুখি বসে ইমামতি করতেন। কথিত নামাজের সময় ‘আব্বা আল্লাহ ইমাম মাহাদি হুজ্জাতুল্লা’ বলে এক কালিমা প্রায় ১৫-২০ মিনিট বলতেন।

আর প্রতিবছরের আট সেপ্টেম্বর থেকে নয় নভেম্বর লুৎফোর ও তার অনুসারীরা রোজা রাখতেন। সকাল আটটার আগে তারা সেহেরি খেতেন। অর্থাৎ অন্য দিনের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ খাবার খেয়ে। মাগরিবের আজানের আগে কারও ক্ষুধা লাগলে ১০০ গ্রাম মুড়ি বা দুটি বিস্কুট খেয়ে পানি খেতেন। রোজার এক মাস তারা মাছ ও মাংস জাতীয় খাবার পরিহার করতেন। তার এ চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘনের শাস্তি দিয়েছে এলাকাবাসী।

গত শনিবার খুন হওয়ার পর লুৎফোরের লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে আনা হলে, তাকে দাফন করা নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। স্থানীয় এলাকাবাসী তাকে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করতে না দেওয়ায় তাকে বাড়ির উঠানেই দাফন করতে হয়েছে।

তবে লুৎফোরের বড় ভাই ফরমান আলী জোয়ার্দার দাবি, তার ভাই কোনো ধর্মদ্রোহী ছিলেন না। তিনি নিয়মিত গ্রামের বাড়ি আসতেন। সে ও তার পরিবারের লোকজন সিরাজগঞ্জের নাটিয়াপাড়ার কাজিপুর গ্রামের মাওলানা মোহাম্মদ শামসুল হক তিরবীজ পীরের মুরিদ ছিলেন। সেই পীর এখনও তাদের বাড়ি আসেন। আর গাজীপুরের শাহজাহান আলী চিশতির মুরিদও তারা। তিনি দাবি করেন, তার ভাই অনেক জ্ঞানী লোক ছিলেন।

কিন্তু ১৬ বছর আগে গ্রামে লুৎফোরের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, প্রচলিত ইসলাম ধর্মের বাইরে ছিলেন তার ভাই। তিনি অর্থের বিনিময়ে মসজিদে ইমামতি করাকে ঘৃণা করতেন। তার ভাই যা বলতেন সেটা কুরআনের আয়াতের বরাত দিয়েই বলতেন। কিন্তু সেটা তাদের গ্রামবাসী বুঝতে না পারায় তার সঙ্গে মতোবিরোধ হয়। আর এ কারণেই লুৎফোরকে গ্রাম থেকে বের করে দেন এলাকাবাসী। তবে তিনি লুৎফোরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা ও তার জেল খাটার কথা স্বীকার করেন। লুৎফোরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের আলেমরাই তাকে হত্যা করেছে।

এদিকে লুৎফোর নাকি স্থায়ীভাবে গ্রামে চলে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্য গ্রামে ঘরও বানাচ্ছিলেন তিনি। তবে লুৎফোরের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যান তার ভাই।

এলাকাবাসীর ভাষ্য কিন্তু ভিন্ন রকম। দীর্ঘ ১৬ বছরে লুৎফোরকে কেউ এলাকায় দেখেননি। এলাকা থেকে বের করে দেওয়ার আগে লুৎফোর কিছু ধর্মীও মতবিরোধের সৃষ্টি করে। এতে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবে ছোট বেলায় তিনি খুব আল্লাহ-ভক্ত লোক ছিলেন। ঢাকায় যাওয়ার পর তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না তারা।

এদিকে লাশ দাফন করা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চরভড়ুয়া কবরস্থান নির্বাহী কমিটির এক সদস্য রাইজিংবিডিকে জানান, লুৎফোরের লাশ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করতে চাইলে এলাকাবাসী তাতে বাধা দেয়। ধর্মদ্রোহী হওয়ায় তাকে এলাকায় কেউ দাফন করতে দিতে চাচ্ছিলেন না। পরে লুৎফোরের পরিবারের সঙ্গে চুক্তি হয় এলাকাবাসীর। নিজ বাড়ির উঠানেই দাফন করতে দেওয়া হবে। আর এখন থেকে তার পরিবারের সদস্যরা প্রচলিত ইসলামি ব্যবস্থায় জীবন যাপন করবে। সেই দাবি মেনে নেওয়াতেই তাকে গ্রামে প্রচলিত ইসলামি নিয়মে দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে লুৎফোরের অতীত সম্পর্কে জানতে তার গ্রামে গেলে রহস্যময় আচরণ করে গ্রামবাসী। যে লুৎফোরকে তারা গণধোলাই দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিলো, যার লাশ গ্রামে প্রবেশ ও দাফন করতে যারা বাধা দিয়েছিলো, তারাই ‘এমন কিছু হয়নি’ ও ‘লুৎফোর ভালো মানুষ’ বলে দাবি করেন। তবে সংবাদকর্মী পরিচয় দেওয়ার পর যমুনা নদীর তীরবর্তী এই গ্রামের বেশিরভাগ লোকই লুৎফোরকে চিনেন না আর তার নামও শোনেননি বলে এড়িয়ে যান।

এদিকে লুৎফোরের শ্যালক আবদুর রশিদ রাইজিংবিডিকে বলেন, তার দুলাভাই (লুৎফোর) কিছুটা ধর্মবিরোধী ছিলেন। তবে তিনি কোন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। জীবনে অনেক টাকা আয় করেলেও তার ঢাকায় কোনো বাড়ি ছিলো না। ব্যাংকেও কোন জমানো টাকা নেই বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে এত টাকা উপার্জন করেও কোন জমানো টাকা নেই কেন, এমন প্রশ্নের কোনো সুদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

লুৎফোরের সঙ্গে তার বড় ছেলে সিটি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সরোয়ারুল ইসলাম ফারুকের স্ত্রী বিথি রাইজিংবিডিকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সন্ধ্যার আগে আট জনের একটি দল তাদের বাড়ি আসে। আর মাগরিবের নামাজের পর তারা বাসার মহিলাদের এক ঘরে আটকে রেখে এই হত্যাকাণ্ড চালায়। এ সময় হত্যাকারীরা অলঙ্কার ও নগদ প্রায় তিন লাখ টাকা লুট করে। গ্রামের বাড়িতে ঘর তৈরির জন্য এই টাকা ছিলো বলে জানান তিনি।

বিথি আরও বলেন, ঘাতকরা হটাৎ করে তাদের ঘরে ঢুকে তার শাশুড়ি, ননদ, তাকে ও কাজের লোকদের চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। আর হতাকাণ্ড ঘটানোর পর যাওয়ার সময় হত্যাকারীরা তার দেবর আব্দুল্লাহকে খুঁজতে থাকে। এ সময় তারা বলে, লুৎফেরাসহ ছয় জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে এক ব্যক্তি তাদের এখানে পাঠিয়েছেন বলেও দাবি করে দলটি।

নিহত লুৎফোরের ছোট ছেলে ও হত্যাকাণ্ড মামলার বাদি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আব্দুল্লাহ আল ফারুক রাইজিংবিডিকে বলেন, তার বাবা একটি গার্মেন্টে এ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) হিসেবে কাজ করতেন। কিছুদিন বায়িং হাউজের ব্যবসাও করেছেন। পরে তিনি সব ছেড়ে দেন এবং ১৯৯৭ সাল থেকে ইমাম মাহাদির ‘প্রধান সেনাপতি’ দাবি করে লেখালেখি করতে থাকেন। দালের শিকল, আদী নূর ও শরিয়তে মাহাদির কথা শিরোনামে তিনটি বই লিখেছেন। মতাদর্শের বিষয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব চিঠি পাঠিয়েছেন সেগুলো নিয়ে একটি বই বের হয়। এ মতাদর্শ প্রচারের কারণেই তার বাবা খুন হয়েছেন বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরও বলেন, তার বাবা আর ভাই ছাড়া যারা খুন হয়েছেন তাদের নাম নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সঠিক পরিচয় ছিলো, তার বাবার মুরিদ ভোলার শাহীন, নীলফামারির মুজিবর রহমান, কুমিল্লার রাসেল ও তাদের বাসার কেয়ারটেকার সিরাজগঞ্জের মঞ্জু।  এদের মধ্যে মুজিবরের বাড়ি অনেক দূরে বলে তার বাবার সঙ্গেই কবর দেওয়া হয়। নিহতরা সবাই তাদের বাসায় থাকতো।

তিনি আরও বলেন, শনিবার বিকেলে তার বাবার মোবাইলে একজন ফোন দিয়ে জানায়, তারা সেনাপতি সাহেবের কাছে জানার জন্য ও তার মুরিদ হওয়ার জন্য আসবে। পরে বাসার কাছে এসে তারা বাসা চেনার জন্য তার বাবার মোবাইলে ফোন দেয়। এ সময় শাহীনকে পাঠানো হয় তাদের বাসায় নিয়ে আসার জন্য। পরে শাহীন তাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আগতদের আপ্যায়নের জন্য বাজার করতে যায়। তার ধারণা, হতাকাণ্ড চালানোর সময় শাহীন হঠাৎ করে চলে এসেছিলো। তার কারণ, তাদের বাসায় বাজার সব সময় শাহীন করতো আর বাজার সরাসরি রান্না ঘরে আনা হতো। অথচ সেদিন বাজারের ব্যাগ তার বাবার রুমে পড়ে ছিল। শাহীন ও মজিবুর প্রায় তিন বছর ধরে তাদের বাবার বাসায় থাকতো। আর মঞ্জু এক বছর ও রাসেল অল্প কিছুদিন ধরে তাদের বাসায় ছিল। রাসেলের শারীরিক আকৃতি তার মতোই ছিল। পরিবারের ধারণা, রাসেলকেই আব্দুল্লাহ মনে করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি জানান, প্রতি শনিবার ও সোমবার তার বাবার মুরিদদের মধ্যে থেকে ১০-১২ জন  করে আসত। যারা আসত তাদের আগে থেকেই নাম দিতে হতো ও অনুমতি নিতে হতো।

লুৎফোরের এই ছেলে আরও জানান, তাদের কাজের লোক হত্যাকারীদের মধ্যে দুইজনকে দেখতে পেরেছে। তাদের চেহারার বর্ণনাও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের কারণ সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাবা অনেক জ্ঞানী ছিলেন। চারটি ভাষায় তার দক্ষতা ছিল। তিনি জীবহত্যা পছন্দ করতেন না। তার মুরিদরা একটা মশা মারলেও তিনি রাগাণিত্ব হতেন। কারণ সেই মশাটার মধ্যেও জীবন আছে। প্রচলিত ইসলামি ব্যবস্থার বাইরে কথা  বলাতেই তাদের বাবা ও ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি মামলাও করেছেন। তিনি বলেন, তার বাবার ঈমাম মাহাদিকে নিয়ে লেখা চিঠির প্রতিলিপি দেশের মন্ত্রী-এমপি, শিক্ষাবিদ, নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন আলেমদের দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন দেশে যে কেউ মত প্রকাশ করতে পারে। তার বাবাও কুরআনের আলোকে তার মত প্রকাশ করেছিলেন। আর সেটাই তার কাল হলো।

কারা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তার বাবার কোন শত্রু  ছিল না। তবে আলেমরা তার বাবাকে প্রতিপক্ষ ভাবতো। কারোর সঙ্গে কোনো আর্থিক লেনদেনও ছিল না। তাদের বাসার ওপর সেলিম নামের এক হুজুর থাকতেন। তিনি তাদের আগের বাসার ওপরেও থাকতেন। তার বাবার মতাদর্শ নিয়ে প্রায়ই সেই হুজুরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হতো। তার বাবাকে (লুৎফোর) কয়েকবার হুমকিও দিয়েছিলেন ওই হুজুর। প্রায় আট মাস আগে গোপীবাগের এই বাসায় আসার পর সেই হুজুরও এই বাসায় চলে আসেন আর তাদের ওপর তলায় বাসা ভাড়া নেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর নিজের জীবন নিয়েও শঙ্কিত বলে জানান আব্দুল্লাহ।

তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা পূর্ব শত্রুতা যাই হোক না কেন, এক সঙ্গে ছয় জনকে হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে নিহতের পরিবার ও গ্রামবাসী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top