সকল মেনু

২৪ অক্টোবরের পর ব্যাপক সহিংস ঘটনার আশংকা প্রশাসনের প্রস্তুতি প্রস্নবিদ্ধ

Chadpur শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর:   সরকারের শেষ দিকে এসে চাঁদপুরে ব্যাপক সহিংস ঘটনার আশংকা করা হচ্ছে। বিশেষ করে আগামী ২৪ অক্টোবরের পর চাঁদপুরের কচুয়া, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, সদর এবং হাইমচর উপজেলায় রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করা হ্েচ্ছ। পরিস্থিতি মেকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতিও তেমন জোরালো নয়। ফলে জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা বরাবরই অত্যন্ত স্পর্ষকাতর এলাকা। এই উপজেলায় জাতীয় সংসদের ২৬০ নম্বর আসনের অবস্থান। যা স্থানীয়ভাবে চাঁদপুর-১ আসন নামে পরিচিত। কুমিল্লার দাউদকান্দি, চান্দিনা, বড়–য়া উপজেলা বেষ্টিত এই এলাকাটিতে শিক্ষিতের হার যেমন বেশি তেমনি এখানে রাজনৈতিক সহিংসতাও বেশি। এই উপজেলার রাজনীতি আবর্তিত হয় বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে কেন্দ্র করে। এখানে আ’লীগ ও বিএনপি’র সমর্থন প্রায় সমান সমান। এই আসন থেকে স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আ’লীগ নেতা মরহুম অ্যাডভোকেট আব্দুল আউয়াল। ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা আলফাজউদ্দিন। ১৯৮৬ সালে সাবেক বিএনপি নেতা মরহুম রফিকুল ইসলাম রনি স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত হন বারডেম হাসপাতালের রেডিওগ্রাফি বিভাগের প্রধান ও জাতীয় পার্টি নেতা ডাঃ এ কে এম শহীদুল ইসলাম। ১৯৯১ সালে বিজয়ী হন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বড় ভাই ও ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসির মামুনের বাবা মেসবাহউদ্দিন খান। তিনি আ’লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা ও কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মরহুম আবুল হাসানাত। তিনি সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। ২০০১ সালে নির্বাচিত হন তরুণ বিএনপি নেতা আ ন ম এহসানুল হক মিলন। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন আ’লীগ নেতা ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই আসনটি বিএনপি’র অনুকুলে। কচুয়ার দুর্ভাগ্য এটাই যে উচ্চ শিক্ষিত দুইজন রাজনীতিবিদ থাকা সত্ত্বেও সেখানে রাজনৈতিক সহাবস্থানের সংস্কৃতি আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। পাবলিক পরীক্ষার জন্য এক সময়কার নকলখ্যাত ও পরবর্তীতে জেএমবি’র জঙ্গিখ্যাত এলাকা কচুয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বিশেষ করে আ’লীগ নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং বিএনপি নেতা আ ন ম এহসানুল হকের মধ্যে একের প্রতি অপরের ক্রোধ এত বেশি যে, সেখানে নির্বাচন মানেই সংঘাত। রাজনৈতিক বৈরিতা যেন ব্যক্তিগত শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এই বৈরী ভাব জোড়ালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। সে সময় ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে অগনিত মামলা হয়েছে। আ’লীগ অফিস ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের উপর একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমন কী কচুয়া বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে তার মাথায় তরমুজ পর্যন্ত ফাঁটানো হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত কচুয়ায় ১১ টি রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেই ৫ বছর আ’লীগ নেতা-কর্মীরা ছিলেন কচুয়া ছাড়া। যারা কচুয়ায় ছিলেন তাদের নিয়মিত নির্যাতন সহ্য করে ও মাসোহারা দিয়ে থাকতে হয়েছে। অনেকে বৃদ্ধ মা বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও প্রাণের ভয়ে তাদের শেষ দেখা দেখতে এবং দাফন-কাফনে অংশ নিতে পারেন নি। ফলে তাদের ভেতর সৃষ্টি হয় বিস্ফোরোন্মুখ অবস্থার। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এবার আ’লীগ নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে বিএনপি নেতা-কর্মীরা বাড়ি ছাড়া। হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল। সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে গত ৫ বছরে ৩৪ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাকে দেড় বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তার বাড়ি ঘরে একাধিকবার হামলা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে তিনি এলাকাছাড়া। এক মুহুর্তের জন্যও এলাকায় যেতে পারেন নি প্রাণের ভয়ে। সেখানে বিএনপি কোন মিছিল মিটিং করতে পারছে না। তাদের রাস্তায় নামারই কোন উপায় নেই। এমন কী ঢাকায় পর্যন্ত বিএনপি নেতারা মিটিং করতে পারেনি ঠিকভাবে। তাদের পুলিশ দিয়ে দাবড়ানো হয়েছে। র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে মারা গেছে কয়েকজন। পুলিশ দিয়ে যেমন হয়রানী করা হচ্ছে তেমনি পেশি শক্তির ব্যবহারও চলছে। জামিন পাবার পর বিএনপি নেতাদের আবার জেল গেট থেকে গ্রেফতার করানো হচ্ছে। গত ১৭ অক্টোবর জেল হেফাজতে যুবদলের সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলাল (৪৬) মারা যায়। এর প্রতিবাদে গত ১৯ অক্টোবর কচুয়ায় হরতাল আহ্বান করে বিএনপি। গত পাঁচ বছরের ভেতর এটাই ছিল বিএনপি’র কচুয়ায় দেয়া কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি। অভূতপূর্ব হরতাল হয়েছে সেদিন। বিএনপি কর্মীদের সাথে পুলিশের কয়েকদফা সংঘর্ষ হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বিএনপি ও এর সহযোগি সংগঠনের দেড় হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ বাদি হয়ে ৩ টি মামলা দায়ের করেছে। এহসানুল হক মিলন কচুয়া তথা চাঁদপুরের ধারে কাছে না থাকলেও তাকে প্রতিটি মামলায় এজহারভুক্ত প্রধান আসামি করা হয়েছে। এসব কারণে কচুয়া বেশ উত্তপ্ত। বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা শুধু সরকারের মেয়াদ শেষ হবার অপেক্ষায় রয়েছে। তারা এহসানুল হক মিলনের নেতৃত্বে ২৪ অক্টোবরের পর যে কোন দিন কচুয়ায় প্রবেশ করতে পারে। আর তা যদি হয় তাহলে কচুয়ায় রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। অন্তত গত ১৯ অক্টোবরের হরতাল তাই জানান দিয়ে গেছে। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ আরেক আতংকের নাম। এখানে বিএনপি ও আ’লীগের মধ্যে বিরোধের চাইতে আ’লীগ বনাম আ’লীগ, বিএনপি বনাম বিএনপি’র মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে এখানে এই বিরোধ চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। জেলা আ’লীগ সভাপতি ড. মোঃ শামছুল হক ভ’ইঁয়া এই আসন থেকে ২০০১ এবং ২০০৮ সালে আ’লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। মনোনয়ন দেয়া হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ইত্তেফাকের সাবেক সিনিয়র সাংবাদিক মাওলানা শফিকুর রহমানকে। এ নিয়েই বিরোধ। সেই বিরোধ এতটাই যে, প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। সবশেষ গত ১১ অক্টোবর সাংবাদিক নেতা শফিকের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তার অভিযোগ, শামছুল হক ভ’ঁইয়ার লোকজন অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়া, গাড়ি ভাংচুর এবং তাদের কর্মীদের মারধর করেছে। ফরিদগঞ্জের ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভ’ঁইয়ার তল্পিবাহক। অপরদিকে বিএনপির বিরোধ আরো তুঙ্গে। ফরিদগঞ্জের বর্তমান সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে উপজেলা বিএনপি’র সাবেক আহবায়ক ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ এম এ হান্নান এবং উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন পাটওয়ারী। এদের বিরোধ চরমে। প্রায়ই এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেখানে টাকার খেলা চলে কর্মীদের নিয়ে। নেতারা দল ভারী করার জন্য দেদারছে টাকা খরচ করেন। ঈদ এল ঘটা করে জাকাতের কাপড় বিতরন করেন। গত ১৭ অক্টোবর এম এ হান্নান নিজের দলীয় সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে তাকে প্রাণনাশের হুমকি প্রদানের অভিযোগ এনে থানায় জিডি করেছেন। এরপর হান্নান সমর্থকরা এমপি’র বিরুদ্ধে ফরিদগঞ্জে ঝাড়– মিছিল করেছে। আবার এমপি সমর্থকরা হান্নানের অভিযোগকে মিথ্য আখ্যায়িত করে প্রতিবাদ সভা করেছে। মাসকয়েক আগে দু’গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। হান্নান গ্রুপের নেতা ও ফরিদগঞ্জের পৌর মেয়র মঞ্জিল হোসেনের উপর তার অফিসে হামলা হয়েছে। পৌরসভার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মঞ্জিল গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাজীগঞ্জে বিএনপি ও বিএনপি’র মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। সাবেক সংসদ সদস্য এম এ মতিন গ্রুপের সাথে জেলা বিএনপি সভাপতি মমিনুল হকের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আ’লীগ এবং বিএনপি’র মধ্যেও প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত ১০ মাসের ভেতর দু’বার বিএনপি অফিস ভাংচুর ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। বিগত নির্বচনগুলোর আগে ও পরে দেখা গেছে হাজীগঞ্জের রামচন্দ্রপুর বাজার, হাটিলা, রাজারগাঁও, দেশগাঁও, হাজীগঞ্জ বড় পুলের দুপাশে, কালোচোঁ, কাপাইকাপসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বাড়ি-ঘর, দোকান-পাটে হামলা, অগ্নিসংযোগ এমনকী খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। হাজীগঞ্জে নির্বাচন এলেই সংখ্যলঘুদের উপর হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। চাঁদপুর শহর মোটামুটি সম্প্রীতিপূর্ণ এলাকা হলেও শহরতলীতে ২৪ অক্টোবরের পর সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে। চাঁদপুর সদরের বহরিয়া-লক্ষীপুর, চান্দ্রা, হরিণা, দোকানঘর, রঘুনাথপুর বাজার, বাগাদী চৌরাস্তা, বাবুরহাট, শাহতলী, আশিকাঠি, পাইকাস্তা, চাঁদখার পুল, হাপানিয়া, মদনা, কুমারডুগি, মহামায়া, মদনেরগাঁও, সেনের দীঘির পাড়, মুন্সীরহাট বাজার, কাজীরবাজার, শহরের বড়ষ্টেশন, ষোলঘর, চেয়ারম্যানঘাটা, বাসষ্ট্যান্ড, চিত্রলেখার মোড়, মিশন রোড, ছায়াবাণী, মিশন রোড, পুরানবাজার – প্রভৃতি এলাকায় সহিংস ঘটনার আশংকা রয়েছে। হাইমচরের উপজেলা সদরে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। চাঁদপুর এবং হাইমচরে বিএনপি’র সাথে বিএনপি’র সংঘর্ষের আশংকাই বেশি। Chadpurউদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী ধরনের প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে – এমন বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোঃ ইসমাইল হোসেন জানান, চাঁদপুরের কচুয়ায় পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবের দুইটি টিম নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া জেলার নিরাপত্তায় পুলিশের পাশাপাশি দুই প্লাটুন বিজিবি টহল দেবে। প্রত্যেক উপজেলায় টিএনওদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে। এছাড়া নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটরাও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top