সকল মেনু

আমদানি সিদ্ধান্ত দেরিতে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন

চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি শুরু হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উৎসাহিত করতে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, চালের দাম বাড়তে থাকায় পাঁচ মাস আগেই প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে চাল কেনার অনুমোদন দিয়েছিলেন। আগস্টে নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ডিসেম্বর মাস গড়িয়ে গেল কেন? আমদানি শুরু করতে অনেক বেশি সময় নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আর এই সময়ের মধ্যে দেশের বাজারে চালের দাম অনেকটা বেড়ে গেছে। ভোগান্তি বেড়েছে ভোক্তা জনসাধারণের।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেওয়ার সাড়ে তিন মাস পর নভেম্বরের ১৬ তারিখে প্রথম ৫০ হাজার টন চাল আমদানির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এরপর পর্যায়ক্রমে এ পর্যন্ত চার লাখ টন চাল আমদানির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন আসবে টেন্ডারের মাধ্যমে। বাকি দেড় লাখ টন জি টু জি পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ভারত থেকে পাঁচ হাজার টন চাল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একই আকারের আরো দুটি চালান আসবে।

সূত্র জানায়, চাল আমদানির বিষয়ে শীর্ষ পর্যায় থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর খাদ্য অধিদপ্তর চাল আমদানি শুরু ও শুল্ক কমানোর জন্য বলেছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু মন্ত্রণালয় আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি। শুল্ক কমাতেও অনেক সময় নিয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব তাহমিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো উত্তর দিতে পারব না।’

জানা যায়, মূলত সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত চাল না থাকলে সুবিধাবাদী মজুদদাররা কৃত্রিমভাবে চাল সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। এবারও তা-ই হয়েছে। নানা কারণে সরকারি গুদামে চালের মজুদ অর্ধেকে নেমে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আমদানির হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত মিলাররা সরকারি গুদামে চাল দেয়নি। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। আবার সরকার আমদানিপ্রক্রিয়া শুরু করায় বাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ১০ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা নিয়ে শুল্ক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর প্রভাবে এরই মধ্যে দেশের বাজারে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যে চালের দামও কমবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশে ধান-চালের অন্যতম বড় মোকাম নওগাঁর বিভিন্ন বাজারে গত সোমবার সকালে প্রতি মণ মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ৬০ টাকায়। অথচ আগের দিন এই ধান বিক্রি হয়েছে এক হাজার ১৬০ থেকে এক হাজার ১৭০ টাকায়। আর গুটি স্বর্ণা (স্বর্ণা-৫১) আগের দিন এক হাজার ১২০ থেকে এক হাজার ১৩০ টাকায় বিক্রি হলেও পরদিন সোমবার বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৩০ থেকে এক হাজার ৪০ টাকা মণ।

বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার কারণে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আট লাখ টন চাল কম উৎপাদন হয়। সেই ঘাটতি পূরণে সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। আমদানি হয় ৪২ লাখ টন চাল। এর প্রভাবে অবশ্য পরের বছর ধানের দাম কমে গিয়ে লোকসানে পড়েন কৃষকরা। তাই এবারও সেই সংকটের পুনরাবৃত্তি চান না বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, চাল আমদানি হলে বাজারে দাম কমে আসবে। তবে সরকারি গুদামের জন্য যতটুক প্রয়োজন শুধু ততটুকুই যেন আমদানি হয়। সবচেয়ে ভালো হয় যদি সরকার নিজেই পুরোটা আমদানি করে। বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির সুযোগ যেন দেওয়া না হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) গত সপ্তাহে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, চলতি আমন মৌসুমে কয়েক দফা বন্যায় দেশের প্রায় ৩৫টি জেলায় আমনের আবাদ বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে গত বছরের তুলনায় এবার আমনের উৎপাদন প্রায় ১০ শতাংশ বা সাড়ে ১৫ লাখ টন কম হতে পারে। গত বছর আমন মৌসুমে এক কোটি ৫৫ লাখ টনের কিছু বেশি চাল উৎপাদন হয়েছিল। তবে উৎপাদন ও চাহিদা বিবেচনায় দেশে খাদ্যঘাটতির কোনো আশঙ্কা আপাতত নেই। আগামী জুন পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করেও কমপক্ষে ২৮ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।

কৃষি সম্প্রসারণ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাঠ ফসলের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৬ লাখ টন। এটা লক্ষ্যমাত্রা থেকে মাত্র এক লাখ টন কম। তবে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) বলছে, চলতি বছর চালের মোট উৎপাদন কমবে সাড়ে পাঁচ লাখ টন।

সম্প্রতি গ্লোবাল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (গেইন) তাদের প্রতিবেদনে বলে, চলতি অর্থবছরে চাল উৎপাদন কমে দাঁড়াবে তিন কোটি ৫৩ লাখ টন, যা গত বছর ছিল তিন কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। অর্থাৎ পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টন কম। গত অর্থবছর এক কোটি ৪০ লাখ টন আমন চাল উৎপাদন হলেও চলতি অর্থবছর তা কমে এক কোটি ৩৩ লাখ টনে নামতে পারে। অর্থাৎ আমন চালের উৎপাদন কমতে পারে সাত লাখ টন।

বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন রনি গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘যারা মজুদ করে তারা সব সময় সরকারি গুদামের দিকে খেয়াল রাখে। সরকারি গুদামে চাল কমে গেলে তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। তাই চাল আমদানি করাই যুক্তিযুক্ত। তবে বেশি আমদানি হলে আগামী মৌসুমে ধানের দাম পাবেন না কৃষক। তাই খেয়াল রাখতে হবে যেন ১০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি না হয়।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top