সকল মেনু

শেষ সংগ্রামের জীবন বাসচাপায় !

হটনিউজ ডেস্ক: রাজীব হোসেন। গত ৩ এপ্রিল রাজধানীতে দুই বাসের চাপায় এক হাত বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল মৃত্যু হয় তার। পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি— শিক্ষকদের এই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন রাজীব হোসেন (২২)। তিতুমীর কলেজে অনার্স পড়তেন তিনি। বন্ধুরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত, তখন তার সময় কাটতো টিউশনি নিয়ে। বাবা-মা হারা ছোট দুই ভাইয়ের অভিভাবক ছিলেন তিনিই। সকালে শুরু করে এ তরুণের দিন শেষ হতো গভীর রাতে। সারাদিন জ্যামের ঢাকা চষে কাজ করতেন নিজের ও পরিবারের উন্নয়নে। কোটি কোটি মানুষের এই শহরে শ্রমের ঘামে জেগে থাকা রাজীবকে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ চিনতেন না। রাজধানীর কাওরান বাজারে বাস থেকে নামার সময় দুই বাসের চাপায় তার একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

গণমাধ্যমে খবরটি ছবিসহ ছাপা হলে দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে দেখতে যান রাজীবকে। সুস্থ হলে তাকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাসও দেন। তার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে ঢামেক। তার জন্য গঠিত হয় মেডিক্যাল বোর্ড। এর প্রধান ডা. শামসুজ্জামান শাহীন জানান, সুস্থ হলে রাজীবের বিচ্ছিন্ন হওয়া হাত কৃত্রিমভাবে স্থাপনের চেষ্টা করা হবে।

রাজীব চলে যাওয়ায় ব্যর্থ হয়ে গেলো চিকিৎসকদের সব চেষ্টা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসও কাজে লাগলো না। তার মৃত্যুতে একইসঙ্গে ‘মা ও বাবা’কে হারালো দুই ভাই মেহেদী হাসান (১৩) ও আব্দুল্লাহ (১১)। বড় ভাইকে হারিয়ে এই দুই কিশোরের আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে তা নিয়ে রয়েছে দুশ্চিন্তা। মেহেদী হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বললো, ‘ভাই চলে গেলেন চিরদিনের মতো। আমাদের পড়ার খরচ কে চালাবে জানি না।’

নিজেদের লুকাতে টিভি ক্যামেরা এড়িয়ে সরে গেলো মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহ। কোথায় যাচ্ছো জানতে চাইলে মেহেদীর উত্তর, ‘ভাই তো নাই! এত মানুষের মধ্যে থেকে আর কী করবো? আমরা দুই ভাই কোরান খতম দিলে ভাই নেকি পাবে।’ দুই ভাই জানান, রাজীব হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা অবস্থায় তারা কোরান খতম দিয়েছেন। ঢাকার তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা ও এতিমখানায় তারা পড়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মাকে হারান রাজীব। তিনি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, বাবাও ছেড়ে চলে যান চিরতরে। এরপর থেকে ছোট দুই ভাইয়ের দেখাশোনা ও লেখাপড়ার সব খরচ চালাতেন তিনি।

রাজীবের দুর্ঘটনার পর থেকে সার্বক্ষণিক পাশে ছিলেন তার মামা জাহিদুল ইসলাম। বুকভরা কষ্ট নিয়ে ভাগ্নের মরদেহের ময়নাতদন্ত আর গোসল ও কাফনের প্রক্রিয়ার পুরোটা দেখভাল করেছেন তিনি। ভাগ্নের পরিশ্রমী জীবন প্রসঙ্গে মামা বলেছেন, ‘ও টিউশনি করতো। পাশাপাশি কম্পিউটারের কাজ নিয়েছিল। দিনে ৬০ টাকা করে পেতো। কয়েকদিন আগে থেকে চাকরি খুঁজছিল।’

রাজীবের মৃত্যুতে আইসিইউতে থাকা অন্য রোগীদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দেখা যায় চাপা ক্ষোভ। সুরাইয়া ইয়াসমিন নামের একজন বলেন, ‘আপনারা গণমাধ্যমে এত কিছু নিয়ে লিখেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে লিখতে পারেন না? নিয়ম-কানুন ঠিক থাকলে তো রাজীব ছেলেটা হাত হারিয়ে মরতো না!’ রাজীবের খালা জাহানারা বেগম  বলেন, ‘ও তো মারা গেছে। আর কী বিচার চাইবো?’ রাজীবকে যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়

এদিকে মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) দুপুর সোয়া ১টার দিকে রাজীবের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স ঢামেক চত্বর ছেড়ে যায়। এরপর হাইকোর্ট মসজিদ চত্বরে জানাজা শেষে তাকে পটুয়াখালীর বাউফলের দাশপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে রাজীবের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক চিকিৎসক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘রাজীবের মাথার হাড় ভাঙা ছিল। মস্তিষ্কের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে।’ ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটে মারা যান রাজীব। তার বয়স হয়েছিল ২২ বছর।

যাত্রাবাড়ীর মিরাজিবাগে একটি মেসবাসায় ভাড়া থাকতেন রাজীব হোসেন। গত ৩ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে সার্ক ফোয়ারার সামনে দুই বাসের চাপায় তার শরীর থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ৪ এপ্রিল বিকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি ভর্তি হন ঢামেক হাসপাতালে।

গত ৬ এপ্রিল রাজীবের চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের বোর্ডের অন্য সদস্যরা ছিলেন নিউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অসিত চন্দ্র সরকার, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান, অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম ও অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম।

এর আগে ৪ এপ্রিল দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজিব হাসানের চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য দ্বিতল বাস মালিক বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন মালিককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ কোটি টাকা প্রদানের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। তার মৃত্যুর পর এ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে এখন পরিবার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top