হটনিউজ ডেস্ক: পাঠ্যবইয়ে শুধুমাত্র বানান ভুলের কারণে এনসিটিবি’র তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ, এর বাইরে বিষয়বস্তু ও অলঙ্করণ নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলোর কোনও মীমাংসার পথে হাঁটেনি সরকারি তদন্ত কমিটি। এমনকি অমুসলিম লেখকদের লেখা ঢালাওভাবে বাদ দেওয়ার অভিযোগের কারণেও কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুপারিশ নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র জানায়, পাঠ্যবইয়ে ভুল-ভ্রান্তির জন্য গঠিত কমিটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বানান ভুলের জন্য জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লানা হুমায়রা খান এবং অপর একজনকে বানান ভুলের জন্য দায়ী করা হয়। তবে তৃতীয় ব্যক্তির নাম জানা সম্ভব হয়নি। গত ৯ জানুয়ারি প্রীতিশ কুমার সরকার ও লানা হুমায়রা খানকে ওএসডি করা হয়। এছাড়া আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদীনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। ওইদিনই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির প্রধান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শনিবার (৪ মার্চ) রুহী রহমান বলেন, ‘বানান ভুলের বাইরে কাউকে দায়ী করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে। তবে সার্বিক বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন জানিয়েছেন, কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কমিটির সদস্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক ইলিয়াস হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সার্বিকভাবে সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে তথ্য নেওয়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন। বর্তমানে তিনি সিলেট রয়েছেন, সেখান থেকে ফিরে মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন বলেও জানানো হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বানান ভুল ছাড়া অন্য ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কাউকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়নি। বানান ভুলের জন্য তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বানান ভুলের জন্য সম্পাদক দায়ী, কারণ তিনি অনুমোদন না দিলে কোনও বই ছাপা হবে না। তাই তাকে প্রতিবেদনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।আর তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ পরিমার্জনের দায়িত্বে ছিলেন লানা হুমায়রা খান। এই বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি ভুলভাবে ছাপা হয়েছে। এছাড়া আরও একজন কর্মকর্তাকে বানান ভুল হওয়ার কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তবে তার নাম জানা যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক বিষয়ের শিক্ষক আরেক বিষয় দেখেন এমন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তাকে।
অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট পাল্টানোর জন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভুলের জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে।শিশুদের বইতে ‘ও’ বর্ণ চেনাতে ওড়নার ব্যবহারের জন্য যারা দায়ী তারাও ছাড় পাচ্ছেন এ কারণে। এছাড়াও প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বর্ণ চেনাতে আম গাছ থেকে ছাগলের আম খাওয়ার চেষ্টা নিয়ে ওঠা বিতর্কের ঘটনাতেও কাউকে দায়ী করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে।
ভুল-ভ্রান্তির পাশাপাশি আরও অভিযোগ ছিল নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা বই এবং অষ্টম শ্রেণির আনন্দ পাঠ থেকে হিন্দুসহ অমুসলিমদের নাম সরিয়ে দেওয়া হয়েছে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী। যদিও এ অভিযোগের পর মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখেই পাঠ্যবই প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটি এগুতে পারেনি। কারণ, এই কমিটি অনেকটা বানান দেখার কমিটি বানানো হয়েছে। বানান ভুলের জন্য দায়ী কারা এবিষয়টিসহ সার্বিক বিষয়ে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে ঊর্ধ্বতন মহল থেকে।
এছাড়াও এনসিটিবিতে পদায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকেই ওঠা অভিযোগ হচ্ছে, এখানে বিশেষজ্ঞদের পদায়ন না করে যারা রাজধানীতে যারা থাকতে চান তাদেরসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে।এখানে পাঠ্যবই রচনার পাশাপাশি এগুলো মুদ্রণ ও বিতরণের কাজে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুবিধা থাকায় দুর্নীতির সুযোগও চাইলে মিলে যায়।তাই একশ্রেণির কর্মকর্তা এখানে থেকে নানা ধরনের অনৈতিক সুযোগ নেন এমন অভিযোগও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বিষয়টি স্বীকার করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবির মধ্যে ঝামেলা রয়েছে। এখানে এখনও প্রগতিবিরোধী কিছু লোক রয়েছে। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজে জড়িত থাকেন। তাছাড়া রাজধানীতে থাকার জন্য শিক্ষা ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা সরকারি স্কুল-কলেজ না পেয়ে কৌশল খাটিয়ে এনসিটিবিতে এসে আশ্রয় নেন।কিন্তু এসব কর্মকর্তার বেশিরভাগেরই পাঠ্যবই প্রণয়ন কৌশল সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায় মাঝে মাঝেই বড় ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও শুধুমাত্র এনসিটিবিতে থাকার জন্য অনেকে এক বিষয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে অন্য বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এজন্যও পাঠ্যবইয়ে বানানসহ নানা বিষয়ে ভুল হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে সরকার সংশ্লিষ্ট অমুক-তমুকের নাম ভাঙিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগও পাওয়া গেছে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় চায় এনসিটিবিকে ঢেলে সাজাতে। এ বিষয়ে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।