সকল মেনু

চালাকি আর ভুলে ভরা প্রেসের ৩ মাসের বইমেলা

হটনিউজ ডেস্ক: বইমেলার ২৮ দিনই আসে নতুন বই। ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারির শেষদিন পর্যন্ত দম ফেলারও সময় নাই। শেষ সময়ে প্রকাশক বই দিয়ে সময় দেন দুই দিন। যদি প্রচ্ছদ ছাপাও থাকে তাও এই দুইদিনে ছেপে সেটা সেলাই, আঠা লাগানো, বাঁধাই পর্যন্ত যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। ফলে প্রায় সময়ই ভুল হয়ে যায়। বইয়ের আঠা খুলে যায়, সেলাই এলোমেলো হয়ে যায়, আর দোষ হয় প্রেসের মানুষের, দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।’ বাংলা ট্রিবিউনকে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাবাজারের একটি প্রেসের ম্যানেজার সোহরাব হোসেন।

তিনি আরও বলেন, ‘বই লেখা থেকে বানান দেখা লেখক-প্রকাশক করেন কিন্তু আমরা বইটি উপস্থাপন করি। সেখানে যত্নশীল না হলে ভুল থাকবেই।’ কিন্তু প্রেস সম্পর্কে খারাপ আঠা, সেলাইয়ে অমনোযোগী হাত, কাগজ বদলে কমদামি দিয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগগুলো তোলা হলে সোহরাব বলেন, ‘সেগুলো করে কেউ কেউ। প্রকাশক ভালো মানের হলে, ঠিক সময় প্রেসের টাকা দিয়ে দিলে কেউই তাদের সুনাম খোয়াবে না।’ যদিও প্রেসের কারিগররা স্বীকার করেছেন চালাকি করা হয় নানাবিধ।

রাজধানীর বাংলাবাজার এবং ফকিরাপুলের প্রেসগুলো বইমেলার সময় সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে। অমর একুশে গ্রন্থ মেলার সময় এখানে যেন এক অন্যজগত। রাত-দিন ছাপাখানার চাকা ঘুরেই চলছে। প্রেসে উঁকি দিতেই দেখা যায় বই বাঁধাইয়ের কাজ চলছে। একজন একটি গ্লু মাখানো বেঞ্চে অবিরাম বইয়ের মলার লাগিয়ে চলেছে। আরেকটু ভেতরে এক কিশোর কাটিং মেশিং মাধ্যমে কাগজ কাটছে আর বইয়ের মাপমতো হাজির করে দিচ্ছে। বইয়ে মাঝে কাগজ খারাপ পড়ে কেন প্রশ্ন করতে ছেলেটি বলে, ‘এটা একটা ব্যবসা। অর্ডারে যে কাগজ থাকে তার মধ্যে অল্প অন্য কাগজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তবে নামিদামি বইয়ের ক্ষেত্রে এটা করা যায় না। অফসেট কত রকমের আছে, একটা থেকে আরেকটা খালিচোখে আলাদা করা সবার সাধ্য না।’

এ ধরনের চালাকি যেমন আছে তেমনি তাড়াহুড়ার কারণে প্রতিনিয়ত ভুলও হচ্ছে। জানুয়ারিতে কাজের চাপটা বেশি থাকে প্রেসের কারিগরদের। কথা বলারও ফুরসত নেই তাদের। যখন কথা বলছি তখনই ফোন এলো একটি নামকরা প্রকাশকের। ফোন রেখে প্রেসের ম্যানেজার বলেন, ‘আর বলবেন না, একটা বইয়ের কাভার বদলে গেছে। ভেতরের কনটেন্টের সঙ্গে কাভারের মিল নেই। এখন এক কাজ দুইবার করার হ্যাপা।’

কবে থেকে প্রেসে আছেন জানতে চাইলে ২৫ বছর বয়সী কারিগর রবিউল বলেন, ‘এখানে সবই প্রায় একই নিয়ম, আট দশ বছর বয়সে আমি কারখানায় ঢুকেছি। এরপর থেকে বাঁধাই এর কাজ, ছাপা কাগজ ফর্মা অনুযায়ী ভাজ করা, কাটা, ইন্টারলিভিং, ম্যাচিং, সেলাই আর মলাটের কাজেই ঘুরে ফিরছি। আরও দশবছর এই কাজের মধ্যেই থাকবো, তারপর ম্যানেজার হওয়ার চেষ্টা করবো।’

কত টাকা পান প্রশ্নে বেশ কয়েকটি প্রেসে একইরকম মজুরির কথা জানালেন কারিগরেরা। তাদের কথা মতে, সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ চলে। এই দুই সিফটে (তাদের ভাষায় দুই রোজ) তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা করে পান। সেটা শ্রমিকের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। তবে নতুন কাজে আসে যে শিশুরা তাদের হিসেব আলাদা। মাসে তিনহাজার টাকা বেতন, দুইবেলা খাবার ও খুপরি ঘরে থাকার জায়গা মেলে নতুনদের। প্রতি প্রেসেই বইমেলার সময় বাড়তি লোক নেওয়া হয়, এরপর তাদের কাজ থাকে না। সেসময় একজন দক্ষ শ্রমিক দৈনিক খাওয়ার খরচ ৫০ টাকাসহ ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা আয় করেন।

প্রেসের এই জীবন থেকে কারিগরদের এই মানবেতর জীবনের কথা বলতে গিয়ে শ্রমিক অধিকার কর্মী শহিদুল ইসলাম  বলেন, ‘মালিকের মুনাফামুখী মনোভাব এবং শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে শক্তিশালী সংগঠন না থাকা এর জন্য দায়ী। মালিক তার ব্যবসাটা ঠিকই করছে কিন্তু একজন শ্রমিককে যথাযথ পারিশ্রমিক দেওয়ার বিষয়ে তার কোনও আগ্রহ নেই। আবার এখানে যেহেতু শ্রমিকেরা ছোটবেলায় প্রেসে ঢোকে সেহেতু একধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হয়, প্রেস মালিকেরা সেই সুযোগটাই নিয়ে থাকেন।’

ঠিকমতো সময় দিলে বইয়ের মান ভাল হওয়া সম্ভব কি না প্রশ্নে শ্রাবণ প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী রবীন আহসান  বলেন, ‘অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু লেখক বই দেন শেষ সময়ে, তারপর চান বইমেলার প্রথম সপ্তাহেই বই দেখতে। ফলে প্রেসের ওপর চাপ পড়ে, আর এর খেসারত প্রকাশক-প্রেস মালিক উভয়কই গুণতে হয়।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top