সকল মেনু

গুলশান হামলায় বেঁচে যাওয়া সত্য প্রকাশের জবানবন্দি

prokash-290x162হটনিউজ২৪বিডি.কম : রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী ভারতীয় চিকিৎসক সত্য প্রকাশ। চোখের সামনে দেখেছেন কীভাবে একে একে ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সে দৃশ্য। ভাগ্যের জোরে উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বেঁচে যান তিনি।

নারকীয় ওই ঘটনার বিবরণ দিয়ে ২৬ জুলাই আদালতে জবানবন্দি দেন সত্য প্রকাশ। ইংরেজিতে হাতে লেখা আট পাতার ওই জবানবন্দির বাংলা ভাষান্তর দেশের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

পাঠকদের জন্য সত্য প্রকাশের সেই জবানবন্দির ভাষান্তর হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘সেদিন ছিল শুক্রবার। হলি আর্টিসান বেকারিতে যাব বলে ঠিক করলাম। আমি গাড়িতে করে পৌঁছলাম। গাড়ি পার্ক করে সাড়ে আটটার দিকে ভেতরে ঢুকলাম। আমি বাইরের দিকে বসলাম। যে কোনায় আমার টেবিলটা, সেটার মুখ সামনের দিকে। এর মধ্যেই আমি তন্ময় নামে আমার এক বন্ধুকে ফোন করলাম। ও বলল খাবে না, তবে দেখা করতে আসবে। আমি পাস্তা আর কমলার জুস চাইলাম। ওরা (রেস্তোরাঁ) আমাকে এর সঙ্গে রুটি আর সসেজ দিয়েছিল শুভেচ্ছা স্বরূপ। আমি আমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমি দেখলাম দুই থেকে তিনজন লোক রেস্তোরাঁর মূল ফটকে ধাক্কা দিচ্ছে। তারপর জোরে ঠেলছে। তারপর আমি শব্দ শুনতে পেলাম, যেটা পটকার আওয়াজের মতো মনে হলো।’

‘ছয় থেকে সাতজন লোক রেস্তোরাঁর দিকে ছুটে আসছিল। আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরপরই আমি গুলির আওয়াজ শুনলাম এবং একজনকে পড়ে যেতে দেখলাম। একই সময়ে আমি “আল্লাহু আকবার” স্লোগান শুনলাম। একটা থামের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম একজন মুখে হাত চাপা দিয়ে ছুটছেন। তার মুখে রক্ত ছিল। জাপান, চীন ও কোরিয়ার মতো দূরপ্রাচ্যের কোনো দেশের লোকের মতো চেহারা তার। চিন্তা করলাম, যেকোনো উপায়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এক শ্রীলঙ্কান দম্পতি—যাদের আমি আগে থেকেই চিনতাম, তারাও লুকানোর জন্য থামের পেছনে এসেছেন। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, একজন হামলাকারী মাটিতে পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দম্পতি আসার পরপরই হামলাকারীদের একজন সেখানে এসে বলল, ‘‘লুকিয়ে থাকবেন না। আমরা আপনাদের ক্ষতি করব না। আপনারা এখানে নিরাপদ নন। এক্ষুনি বেরিয়ে আসুন।’’ আমরা তাদের কথামতো বেরিয়ে এলাম। ওই একই হামলাকারী আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করল। আমি আমার মুঠোফোন তাকে দিলাম। শ্রীলঙ্কার ওই দম্পতি তাদের ব্যাগ ছুড়ে দিলেন।’

‘ওই হামলাকারী বলল, বরং বলা উচিত আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি বাঙালি?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমি বাঙালি।” হামলাকারী বাংলায় আমাকে শুয়ে পড়তে বলল। আমি তার কথামতো শুয়ে পড়লাম। কিন্তু শ্রীলঙ্কান দম্পতি তখনো দাঁড়িয়ে। তারপর হামলাকারী (পিস্তল হাতে) আমাকে ভেতরে যেতে বলল এবং অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে বসতে বলল। সে আমাকে চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা নিচু করে রাখতে বলল। টেবিলের নিচে দুই নারী লুকিয়ে ছিলেন। আক্রমণকারীরা তাদের টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে আরেক পাশে বসতে বলল। আমি মাথা পুরোপুরি নামাচ্ছিলাম না দেখে একজন আমার মাথার পেছনে আঘাত করে। ওই মেয়েরা এবং তাদের সঙ্গে থাকা একজন তরুণ তাদের ছেড়ে দিতে কাকুতি-মিনতি করছিলেন। হামলাকারী জবাবে বলল, “তোমরা কাফের বলে আমাদের কাছে গণ্য না হলে আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না।” এ সময় একজন হামলাকারী ইংরেজিতে বললেন, “তোমরা কি জানো, কীভাবে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা সিরিয়ায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন?” তারা দুটি ভাষাতেই কথা বলছিল। আমি শুনতে পেলাম, হামলাকারীদের একজন এক তরুণের সঙ্গে ইসলাম নিয়ে কথা বলছেন (পরে আমি জানতে পারি তার নাম তাহমিদ)। হামলাকারীরা আমাদের ফোন ধরতে বলল। আমি আমার ফোন বন্ধ করে দিলাম। একজন হামলাকারী জানতে চাইলেন, আমি সংবাদমাধ্যম বা পুলিশের কাউকে চিনি কি না। আমি বললাম না। একটা মেয়ে হামলাকারীদের কথামতো তার মাকে ফোন করেন ‘লাউডস্পিকারে’ দিলেন। মেয়েটি বললেন, ‘আম্মা, তাড়াতাড়ি বেনজির আঙ্কেলকে বলো, আমি এখানে (গুলশানে) আটকে আছি।’ তার মা ঘটনা সম্পর্কে তখনো অবগত ছিলেন না। তারপর আরেকটা ফোন বাজল। আমার উল্টো দিকে বসে থাকা এক ব্যক্তি ফোনের স্পিকার দিয়ে কথা বললেন। পরে আমি জানতে পারি তার নাম হাসনাত। তার কথোপকথন আমি মনে করতে পারছি না।’

‘এরপর তারা আমাদের পানি ও মাফিন (কেক) খেতে দেয়। তারা বাথরুমেও যেতে দেয়। বাথরুমে যাওয়ার সময় আমি দেখি, সিঁড়ির গোড়ায় এক নারী পড়ে আছেন। তখন নিজের মুখ ঢেকে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পাই, রেস্তোরাঁর এক কর্মীকে (স্টাফ) হামলাকারীরা বলছে, রান্নাঘরে যারা আছে, তাদের যেন দরজা খুলে বের হয়ে আসতে বলা হয়। (সেই কথামতো) ওই কর্মী ভেতরে থাকা ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করে বললেন, হামলাকারীরা বাংলাদেশিদের হত্যা করবে না। এরপর হামলাকারীরা একবার ব্যর্থ চেষ্টার পর কোল্ড রুম (ভাণ্ডার) খুলতে সক্ষম হয়। এর ভেতরে দুজন ছিলেন। এদের একজন ওই রেস্তোরাঁর কর্মী এবং আরেকজন জাপানি (জাপানি ভাষায় কথা বলছিলেন)।’

‘হামলাকারীরা বাঙালিকে (রেস্তোরাঁর কর্মীকে) অন্যদের সঙ্গে বসতে দেয় আর সেই জাপানি নাগরিককে গুলি করে। তারা জিজ্ঞেস করে, ওই জাপানি লোকটি বেঁচে আছে কি না। জাপানি লোকটি হ্যাঁ বোধক জবাব দিলে হামলাকারীরা আবার তাকে গুলি করে। গুলি করার আগে তারা আমাদের কানে হাত দিতে এবং শিশুদের চোখ ঢেকে দিতে বলে। একপর্যায়ে আমি শুনতে পাই এক নারী যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন। তাকে কোপাতে থাকা এক ব্যক্তি বলছিল, “মহিলা মরতেছে না।” তারা দুটি বড় গ্যাস সিলিন্ডার কাচের দরজার দুই পাশে রাখে। তারা মুঠোফোন, ট্যাবলেট ও ল্যাপটপ ব্যবহার করছিল। মুঠোফোনে খবর পড়ে তারা হাসাহাসি করছিল আর উচ্চ স্বরে বলছিল, “তারা (সংবাদমাধ্যম) আগে আমাদের সন্ত্রাসবাদী বলত, এখন আমাদের জঙ্গি বলছে। না জানি কাল আমাদের কী বলবে।” একপর্যায়ে হামলাকারী আমাদের বাংলায় একটি মেসেজ পড়ে শোনায়। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অভিনন্দন বার্তা। বার্তাটি বেশ বড় ছিল। পুরোটা মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে ওই বার্তায় বলা হয়েছে, তারা খুব বড় কাজ করেছে, এ জন্য তাদের ভাইয়েরা তাদের নিয়ে গর্ববোধ করছে।’

‘এরপর তারা সেহ্‌রি খেতে দেয়। তাদের সন্দেহ এড়াতে আমিও কয়েক গ্রাস খাই। সেহ্‌রির পর তারা আবারও টেবিলের ওপর মাথা রাখতে বলে। অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে, কেউ একজন নির্দেশ দিলেন, দুজন (হামলাকারী) থাকবে ওপরের তলায়, দুজন নিচের তলায়। একজনকে কিছু একটা করতে বলা হয়, যা আমার মনে পড়ছে না। পরে তারা দুজনকে তাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। আমি তাদের (দুই জিম্মিকে) সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখি। কিছু সময় পর তারা ফিরে আসে এবং আমার পাশের টেবিলে মাথা নিচু করে বসে। এ সময় আমি দেখি, একজন হামলাকারী চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি দেখলাম, টাক মাথার লোকটি (হাসনাত) সামনের দরজা খুলছেন।’

‘অন্য সবার সঙ্গে আমি উঠে দাঁড়াই। তারা আমাদের হাত-পা ছড়াতে বলল। এক হামলাকারী তাহমিদকে কোরআন শরিফ দিচ্ছিল। কিন্তু তাহমিদ তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। আমি তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তারা আমাদের ফোন (টেবিলের ওপর রাখা) ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়। আমরা রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করি।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top