সকল মেনু

পর্ব -৩: হাসপাতালে আব্বাজানকে দেখতে আসতেন মুজিব ভাই,খাবার নিয়ে আসতেন ভাবী

 3642_images১৯৭৩ সালের মার্চ মাস। তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে সম্ভবত দশ কি এগারো হবে। একেবারেই অপ্রত্যাশিত ভাবে মুজিব ভাইকে কাছের থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো। প্রায় পনের বছর পর। আমাদের সেই মুজিব ভাই তখোন সদ্য স্বাধীন দেশের নেতা,জাতির জনক ,দেশের প্রধানমন্ত্রী দুনিয়া জোড়া তার নাম। কিন্ত পনের বছর পরও আমার নামটা ভুলেননি। দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছেন। সেই আগের মতই আছেন । আগের মতই আচার ব্যাবহার। একটু ও বদলাননি। অথচ এর মেধ্যে বদলে গেছে গোটা দেশটা। মনে আছে পনের বছর আগে আব্বাজান তখোন হাসপাতালে। আমি থাকতাম হাসপাতালে আব্বাজানের কাছে। প্রায় প্রতিদিন রাতে হাসপাতালে আসতেন মুজিব ভাই। দিনের বেলা আসতেন ভাবী মানে বেগম মুজিব, টিফিন ক্যারিয়ারে আব্বাজানের জন্য খাবার নিয়ে। আব্বাজান বেগম মুজিবের রান্নার প্রশংসা করতেন দারুন ভাবে। বেগম মুজিবের কথা বলতে বলতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন আবু বকর খান ভাসনী। কুড়ি গ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার একবারে আসাম সীমান্তের কাটাঁতারের বেড়া ঘেষা নিভৃত এক পাড়া গায়ে বসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা হচ্ছিলো মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ছেলে আবু বকর খান ভাসানীর সঙ্গে। এ গ্রামেই থাকেন তিনি। মাওলানা ভাসানীর চার স্ত্রীর একজনের পুত্র আবু বকর খান ভাসানী। তিন ছেলেকে নিয়ে এখানে থাকেন তিনি। এদেশের রাজনীতির মহিরুহ হিসেবে বিবেচিত মাওলানা ভাসানীর ছেলের হেন দীনদরিদ্র অবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।  ৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির উৎপত্তিস্থল আসামের ভাসান চর থেকে ফিরে ভাসানী প্রথম ওঠেন ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ওই বাড়িতে। মাওলানা  ভাসানীর অনুসারীদের বিধান অনুসারে হুজুরের ভক্তরা মাথায় বিড়া ছাড়া ঝাকায় করে মাটি কেটে ওই বাড়ির জায়গা উচু করে সেখানে ঘর তুলেন। ওই বাড়িতেই জন্ম আবু বকর খান ভাসানীর । মাওলানা ভাসানী ঢাকায় চলে আসার পর গ্রামের ওই বাড়িতেই থেকে যান আবু বকর খান ভাসানী। কখনো কখনো ঢাকায় এসছেন পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে। গ্রামের ওই বাড়িতে তার সম্বল বলতে আছে মাত্র বাড়ি সহ বিঘা চারেক ধানের জমি। অর্থের অভাবে ছেলে সন্তানদের স্কুলে পড়াতে পারেনি। তবু কখনো পিতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাম ভাঙ্গিয়ে দুপয়সা কামাই করার ধান্ধা করেন নি।
৭৩ সালের মার্চ মাসের  সেই  স্মৃতির কথা বলছিলেন আবু বকর কান ভাসানী। সকাল এগারোটা বাজে। কুড়িগ্রামে গিয়েছি সমাজসেবা অফিসে একটি কাজে। কুড়িগ্রাম সে সময় মহাকুমা শহর। শহরে গিয়ে দেখি শুধু মানুষ আর মানুষ। অফিসে কেউ নেই। সবাই ছুটছে মাঠের দিকে। আগে জানা ছিলো না মুজিব ভাই আসবেন। শহরে গিয়ে জানতে পারলাম মুজিব ভাই কুড়িগ্রামে জনসভা করতে আসছেন দুপুর ১২টায় তার জনসভা। ভাবলাম অনেক দিন দেখি না, দূরে দাড়িঁেয় এক নজর দেখে যাই। কাছে তো যাওয়া সম্ভব নয়। জনসভার মাঠের দিকে রওনা দিলাম। থেমে যেতে হলো প্রায় আধা মাইল দূরে। সামনে আর পা ফেলার জায়গা নেই। পুরো শহরটা জুড়ে বেকল মানুষ আর মানুষ। আরো মানুষ আসছে স্রোতের মত। আমি আরো পিছিয়ে আসলাম। ভাবলাম দূরে নিরিবিলি কোন জায়গায় দাড়িঁয়ে মুজিব ভাইর বক্তৃতাটা শুনি। নিরিবিলি কোন জায়গা পাচ্ছিলাম না। হাটতে হাটতে ডাকবাংলোর দিকে গেলাম। সেখানে অনেকটা নিরিবিলি চার দিকে পুলিশ ডাকবাংলোটা ঘিরে রেখেছে। পুলিশ সেখানে অনেককে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। আমি হাটতে হাটতে বাউন্ডারি পার হয়ে ভেতরে গিয়ে একটি আমগাছের আড়ালে দাড়াঁলাম,আসার সময় মনে হলো পুলিশ আমাকে খেয়াল করেনি। সেখানে দাড়িঁয়ে মাইকে বক্তৃতা শুনলাম।
মিটিং শেষ হলে বের হওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দেখি শত শত পুলিশ এবং আর্মি ডাকবাংলো ঘিরে ফেলেছে । এবং রাস্তায় পা ফেলার জায়গা নেই। আর না এগিয়ে সেখানেই দাড়িঁেয় রইলাম। ভাবলাম লোকজন চলে যাক পরে পথ হালকা হলে আমি রওনা দেব। এর মধ্যে এক কান্ড ঘটলো। দেখি প্রায় ত্রিশ চল্লিশ খান গাড়ি আসছে ডাকবাংলোর দিকে। সামনে আর্মি জোরে জোরে হুইসেল দিচ্ছে। গাড়ির সামনে পেছনে দৌড়াচ্ছে পুলিশ। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চিন্তা করে কুল পাচ্ছিলাম না এখন কি করি কোথায় যাই। এর মধ্যে এক পুলিশ এসে আমাকে কড়া ধমদিয়ে গালি দিলো। বললো এই ব্যাটা তুই এখানে এলি কি ভাবে? তুই তো আমার চাকুরী টা খাইছিস। কথা গুলো বলে পুলিশটা আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে আড়াল করে ঠেসে ধরে রাখলো । কয়েক মিনিট হবে মাত্র  হঠাৎ করে অল্প দূরের রাস্তা থেকে  উচ্চ স্বরে আওয়াজ এই তোমরা বকরকে এভাবে ধরে রেখেছো কেন? ওকে ছাড়ো । এখানে নিয়ে আসো, বলেই গাড়ি থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন মুজিব ভাই। বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন কেমন আছিস বকর। আমি তো কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। শুধু বললাম মুজিব ভাই আপনাকে দেখতে এসেছি। মুজিব ভাই আর গাড়িতে না উঠে আমার হাতে ধরে হাটতে হাটতে ডাকবাংলোর দিকে নিয়ে গেলেন। তারপর অনেক কিছু জানতে চাইলেন,ঢাকায় যাই কি না? আব্বাজানের সাথে দেখা হয় কি না? বিয়ে করেছি কি না ?ছেলে মেয়ে আছে কি না? সংসার চলে কি ভাবে? অনেক কথা। সেখানে খাওয়ার ব্যাবস্থা ছিলো। মুজিব ভাই অন্যলোক সরিয়ে দিয়ে আমাকে তার পাশে বসে খাওয়ালেন। যাবার সময় মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন ঢাকা আসলে দেখা করিস। মুজিব ভাইর সাথে আমার সেইই শেষ দেখা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top