সকল মেনু

মানতা সম্প্রদায়: ওরা চায় স্বাভাবিক জীবন

778aa9da-6f86-4bfc-afb7-e7d2a7ed3f42এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা: সাফিয়া খাতুন (৫৫)। ছোট বেলা থেকেই নৌকাতে বড় হয়েছেন। নৌকাকে ঘিরেই কেটেছে তার শৈশব, কৈশর জীবন-যৌবন। বাপের নৌকা ছেড়ে তার আশ্রয় স্বামীর নৌকাতে। কিন্তু নৌকার এ জাযাবর জীবন তার ভালো লাগেনা।
মানতা সম্পদায়ের বধূ সাফিয়া জানান, দেশের নাগরিক হয়েও কোন নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছিনা। কষ্টের জীবন আর ভালো লাগে না। সরকার যদি আমাগো পূর্ন:বাসনের সুযোগ করে দিতে তাহলে আমাদের মত হাজার হাজার নারী-পুরুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতো।
মো: সাদেক সর্দার (৬৮)। তিনিও নৌকায় বেড়ে উঠেছেন। একটানা প্রায় সাত দশক কাটছে তার। ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে তার। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেরাও সংসার করছে নৌকাতে। তিনি জানান, এ সুর্বিশহ জীবন আর ভালো লাগে না। শেষ বয়সে মূল ভূখন্ডে বেচে থাকার স্বপ্ন তার। মরার আগে তিনিও চান অন্যদের মত স্বাভাবিক জীবন। শুধু সাফিয়া আর সাদের নন। তাদের মত এমন নৌকায় অন্যরকম দিন কাটাচ্ছেন ৭০টি নৌকা বহরের পরিবারের সদস্যরা।
মানব সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ যুগ যুগ ধরে বাস করছেন নৌকাতে। বাপ-দাদার পেশা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে চলছে এদের দিন। অনেকটা কঠিনতর থেকে কঠিন শাস্তির মতই এক ঘেয়েমি জীবন এদের। সরকারীভাবে এদের পূর্ন:বাসনের কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করায় এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছেনা।
মানতা সম্প্রদায়ের এসব মানুষের মধ্যে অনেকেই জানেনা যে তাদের পৈত্রিক ভীটে কোথায় ছিলো। যারা নিজেদের ইতিহাস জানেন’ তারা বলছেন নদী ভাঙ্গন তাদের কেড়ে নিচ্ছে সব কিছু। আজ এখানে তো কাল ওখানে। এভাবেই স্থান ত্যাগ করে চলছে জীবন তাদের। নৌকাতেই এদের কাটে ঈদ উৎসব। সভ্যতার আড়ালে থাকা এসব মানুষের বিয়েও হয় নৌকাতে। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় এদের বিয়ে হয়।
ভোলা বেশ কিছু এলাকায় গিয়ে কথা হয় কয়েকজন মানতা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের সাথে। তারা জানান, সারাদিন তারা নদীতে জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন। কারেন্ট, সান্দি আর পোয়া জাল দিয়ে ইলিশ, পোয়া, পাঙ্গাস আর ছোট বড়-মাঝারী সাইজের বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ শিকার করেন। সেগুলো বাজারে বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলে। কিন্তু এ জন্য তাদের বহু কষ্ট করতে হয়। রোদে পুড়তে হয় আর বৃষ্টিতে ভীজতেও হয় তাদের। কখনও কখনও ঝড়ের মোকাবেলা করতে হয় এসব মানুষকে। আর জলদস্যুর হামলার ভয় তো রয়েছেই। এরা একই স্থানে ২/৩ মাসের বেশী থাকেন না। যেখানে বেশী পরিমানে মাছ ধরা পড়ে উপকূলের সেই স্থানেই তাদের বেশী বিচরন। মাছ ধরা না পড়লে কখনও কখনও পরিবার-পরিজন নিয়ে উপোস কাটাতে হয়। আর এ নৌকার জীবন কাটাতে গিয়ে নদীতে পড়ে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট শিশুর প্রান যায়। তবে তাদের পিতা-মাতারা সন্তাদের বুকে আগলে রাখার আপ্রান চেষ্টা করে থাকেন।
মানতা সম্প্রদায়ের সদস্য জামাল সর্দার (৩১)। এ বয়সেই তার ৫ ছেলে-মেয়ে। পরিবারে তার ৭সদস্য। নৌকাতে গাদাগাদি করেই তাদের একসাথে থাকতে হয়। তিনি বলেন, মাছ পাবার আশায় সারাদিন নৌকা নিয়ে ঘুরতে হয় নদীর একপ্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সারাদিন জাল বেয়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকার মাছ বিক্রি হয়। এরমধ্যে তেল খরচ তো আছেই। মাছ বিক্রি করে যা পাওয়া’ তা দিয়েই দু’বেলা দু’মুখো খাবার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু যখন মাছ কম পড়ে তখন কষ্টের সীমা থাকেনা।
বৃদ্ধ সাদেক বলেন, আমরা সরকারের সহযোগীতা পাইনা। আমাদের দায়িত্ব কেউ নিতে চায়না। আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই।
কদম আলী, সুলতান ও নুরুল ইসলাম বলেন, একটু বেশী মাছ পাবার আশায় তারা গত কয়েক মাসে তারা বেশ কয়েকটি স্থান ত্যাগ করেছেন। এরমধ্যে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, মতিরহাট, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, কালিগঞ্জ, উলানিয়া, ভোলার হুজুরের খাল, মনপুরার গোয়ালিয়া, চরফ্যশনের মনুরা ও ভোলার ইলিশা ফেরীঘাট। কিছুদিনের মধ্যে তাদের আবার নতুন ঠিকানায় যেতে হবে।
মনিরম বিনি বলেন, সবচেয়ে বেশী সমস্যায় ভুগতে হয় তাদের শীত মৌসুমে। কারন এ সময়ে নদীতে মাছ খুব কম ধরা পড়ে।
মানতা গহবধূ মনরঞ্জন বিবি বলেন, নৌকার জীবন খুবই ঝূকিপূর্ণ। প্রতিটা দিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। নদীর উত্তাল ঢেউ কখন যে নৌকা ডুবিয়ে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্ছাদের নিয়ে বেশী টেনশনে থাকতে হয়।
জামালের স্ত্রী হাসিনা বলেন, আমাগো ছবি তুইল্যা কোন লাভ নেই। সরকার আমাগো কোন খবর নেয়না।
সাফিয়া খাতুন বলেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভোটার হয়েছেন। এরমধ্যে তিনিও ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের একজন ভোটার। নির্বাচন এলে কখনও কখনও তাদের ভোট দিতে হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তাদের খোঁজ নেয়না। সরকারী বিভিন্ন বরাদ্দ এলেও নাগরিক হিসাবে ওই বরাদ্দ কোন দিনও তাদের কাছে পৌছায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সামাজিকভাবে অনেকটা মানব সভ্যতা বাইরে বসবাস করার কারনে হয়ত বঞ্চিত করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা তাদের প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করতে পারছেনা। তাই ভোটার হওয়ার বাসনা নেই এখন অনেকের।

মাছ ধরা পদ্ধতি:
এদের মাছ ধরা পদ্ধতি সাধারন জেলেদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন। পোয়া, ইলিশ, পাঙ্গাস আর ছোট ছোট পোনা শিকার করেন। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া মাছ শিকার করে সেই মাছই আবার উপকূলের বিভিন্ন ঘাটে কম দামে বিক্রি করেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা আবার গভীর রাত থেকে ভোর। এরা গভীর নদীতে মাছ শিকারের যান না। উপকূলের কাছকাছি মাছ শিকার করেন। মাছ শিকারে পুরুষরা যেমন মাছ শিকারে পারদর্শী ঠিম তেমনি নারীরাও। সংসার চালাতে উভয়ই প্রচেষ্ঠাই সমান। অল্প বয়স থেকেই এদের সন্তানরা মাছ শিকারের কৌশল শিখে নেয়। বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বদাই প্রস্তুত থাকে এরা।

মানতাদের বিয়ে পদ্ধতি:
একেকটি বহরে ৩০/৭০টি নৌকা বহর থাকে। একযোগে এরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যান। তবে মাছ শিকার করেন ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে। প্রতিটি বহরের সদস্যরা একে অপরের আত্মীয়। তাই বিয়ে হয় আত্মীয়দের মধ্যে। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় বিয়ে হয়। মানব সভ্যতান স্বাভাবিক জীবন থেকে আলাদা হলেও বিয়ে পদ্ধতি অনেক মিল রয়েছে। কাজী ঢেকে এনে বিয়ে দেন। বিয়ে হয় নৌকাতে। আর্থিকভাবে একটু স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যরা সাউন্ড বক্স, মাইক বাজিয়ে নাচ-গান করে বিয়ে উৎসব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে নৌকা বহরের সকল সদস্য দাওয়াত পান। সেদিন সবার মাছ শিকার বন্ধ করতে হয়। এদের বিয়েতে যৌতুক প্রথা নেই বললেই চলে। তবে মেয়ে জামাইকে কেউ কেউ খুশি হয়ে পূন:বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিছুদিন ধরে এরা নিয়ম পাল্টানোর চেষ্টা করছেন এরা। অনেকেই এখন নিজ বহরের নৌকায় ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে চান না। অন্য বহরে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা তাদের। এ ধরনের বেশ কিছু বিয়ে হয়েছে গত কয়েক বছরে। এদের অধিকাংই বাল্য বিয়ে হয়ে থাকে।

নৌকাই জীবন:
মানতা সম্প্রদায়ের শিশুরা জম্মের পর থেকে চোখ দিয়ে নৌকা দেখেন। এই নৌকাই তাদের জীবন। নৌকাতে গোসল, নৌকাতে রান্না, খাওয়া-দাওয়া, নৌকাতে ঘুম, নৌকাতে বিয়ে, নৌকাতেই ঈদ, নৌকাতেই যেন সব। পরিবারের সদস্য বেশী থাকলে দুই বিচানা তৈরী করা হয়। সেখানেই রাত্রি-যাপন। এদের একে অপরের সাথে রয়েছে বেশ ঐক্য। অন্য সভ্যতার কোন মানুষ তাদের হামলা করলে তারা একসাথে তা প্রতিহত করেন। একে অপরের প্রতি তাদের হিংসা বিদ্বেষ নেই বললেই চলে। একজন সর্দার রয়েছে। তিনি নিজেদের মধ্যে ছোট বড় শত জামেলা নিস্পত্তি করেন। তবে বড় ধরনের অপরাধ হলে তা থানা পর্যন্ত গড়ায়।

স্বাস্থ্য চিত্র:
অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশেই এরা বেড়ে উঠতে। নৌকাতে জীবন কাটানোর ফলে এরা স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছেনা। ছোট ছোট শিশু কিশোররা ভুগছে অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে। তবে বয়স্কদের রোগ বালাই নেই বললেই চলে। গর্ভবতি মহিলারা সন্তান প্রসব করেন নৌকাতে। এরা নিজেরাই মহিলাদের জন্মগত সমস্যা সমাধান করেন। জটিল সমস্যা হলেও যেতে হয় হাসপাতালে। তবে অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে না যাওয়ার কারনে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। এদেরই মধ্যে একজন আলমগীরের স্ত্রী শিল্পি। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কিছুদিন এ গৃহবধূ মৃত্যুবরন করেন। এ ধরনের ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটছে বলে মানতা সম্প্রদারের সদস্যরা জানান।

অনিরাপদ জীবন:
মানতাদের জীবন চরম অনিরাপদ। নদীতে জলদস্যুর ভয়ে তাদের প্রতিটিক্ষন কাটাতে হয়। যখন উপকূলের কাছা কাছি থাকেন তখনও চোর-ডাকাতদের ভয়। ঝড়-জলোচ্ছাসের সময় এরা পাচ্ছেনা কোন সতর্কতা সংকেত। তাই দুর্যোগের মধ্যে তাদের থাকতে হয় নদীতে। তখন প্রান হারানো সম্ভাবনা থাকে বেশী।

মানতা সম্প্রদায়ের দাবী:
এখন আর মানতারা নৌকার এক ঘেয়েমি জীবন পছন্দ করেন। তারা স্বাভাবিক জীবন-যাপন চান। চান নাগরিক সকল সুযোগ-সুবিধা। এ জন্য তারা সরকারের কাছে তাদের পূন:বাসনের দাবী জানিয়েছেন। আবাসন প্রকল্পে গৃহতৈরী করে দেয়ার দাবী তাদের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top