সকল মেনু

আব্বা বিচার দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে চলে গেছেন: তানিয়া বখত

জিল্লুর রহমান-আইভি রহমান পরিবার (ছবি:

হটনিউজ ডেস্ক: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি জড়িতদের শাস্তির পাশাপাশি এর পরিকল্পনাকারীদের মুখোশ উন্মোচনসহ তাদেরও শাস্তি চান ওই হামলায় নিহত আওয়ামী লীগের নারী বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের মেয়ে তানিয়া বখ্ত। আগামী মাসে বহুল আলোচিত এ মামলার রায় হওয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘বিচার দেখে যেতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে আব্বা মারা গেছেন। আমরা ১৪ বছর ধরে মামলার বিচারের অপেক্ষায় আছি। শুনেছি সেপ্টেম্বর রায় হবে। আমরা চাই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যারা জড়িত তাদের শাস্তি হবে। আর রায়ের মধ্য দিয়ে মাস্টারমাইন্ডদের সামনে নিয়ে আসা হবে। তাদেরও শাস্তি হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের ঘৃণ্য ঘটনা ঘটানোর আগে চিন্তা করে।’শুক্রবার (২৪ আগস্ট) আইভি রহমানের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২৪ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের অন্তত ২১ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন কয়েকশ মানুষ।
রায়ের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার কথা জানিয়ে তানিয়া বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রায়ের প্রত্যাশা আমরা ১৪ বছর ধরে করে আসছি। যত দেরি হোক বিচারের রায়টা সঠিক যেন আমরা পাই। এখন শুনতে পাচ্ছি সেপ্টেম্বরে রায়টি হবে। আমরাও আশা করছি সেপ্টেম্বরে রায়টা যেন পাই। আশা করি যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও মামলার আসামি, তাদের সবারই শাস্তি হবে এবং এই রায় থেকে পেছনের আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার পেছনে কারা ছিল আমরা তা জানতে পারবো। ঘটনার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ও পেছনে থেকে পুরো পরিকল্পনাটা করেছে সেই মাস্টারমাইন্ডদের যেন সামনে আনা হয়—এটা আমাদের প্রত্যাশা। না হলে এই ধরনের ঘটনা হয়তো আরও ঘটবে। পেছনে যারা ছিল তাদের শাস্তির আওতায় আনা হলে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের জঘন্য নৃশংস ঘটনা ঘটানোর আগে দুবার চিন্তা করবে।’
আইভি রহমানের স্বামী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর ওই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। সে সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। পরবর্তীতে ওয়ান-ইলেভেনের সময় দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন । তার নেতৃত্ব ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা পায় তখন। ২০০৯ সালে দল ক্ষমতায় গেলে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আট বছর সাত মাস পরে দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জিল্লুর রহমান। স্ত্রীকে বঙ্গভবন দেখাতে না পারা এবং স্ত্রী হত্যার বিচার দেখতে না পারার দুঃখ ছিল তার।
এ বিষয়ে তানিয়া বখত বলেন, “রাষ্ট্রপতি হয়েও ২১ আগস্ট হত্যার বিচার দেখে না যেতে পারার কষ্টটা আব্বার মনে ছিল। যতদিন সুস্থ ছিলেন তিনি আমাদের প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার আম্মার হত্যাকাণ্ডের বিচারটা মনে হয় আমি আর দেখে যেতে পারবো না। যদি দেখে যেতে পারতাম!’ এটা উনার একটা আক্ষেপ ছিল। রায় না হওয়ার কষ্ট ওনার ছিল। রায় দেখে না যাওয়ার কষ্টটা নিয়েই উনি মারা গেছেন।”

স্ত্রীকে বঙ্গভবন দেখাতে না পারার আক্ষেপও বাবার মধ্যে ছিল উল্লেখ করে তানিয়া বখত বলেন, “রাষ্ট্রপতি হিসেবে আব্বা যখন বঙ্গভবনে উঠলেন, সে সময় তার মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপও ছিল। তিনি রাষ্ট্রপতি হলেও স্ত্রী আইভি কোনও দিন বঙ্গভবনে তার সঙ্গে থাকতে পারলেন না। তিনি সব সময়ই বলতেন, ‘আমি যদি একবার ওকে বঙ্গভবনে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে আমার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা সার্থক হতো।”
২১ আগস্টের ঘটনা এখনও ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়— এমন অভিযোগ করে তানিয়া বলেন, ‘ঘটনাটি নিঃসন্দেহে সেই সময়কার সরকারের পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ মদতে হয়েছিল। কিন্তু এ বছরও কিছু টিভি চ্যানেলে কিছু সিনিয়র সাংবাদিককে বলতে শুনলাম, ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি সরকারকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তখন খুবই কষ্ট লাগে।’

 নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন একটা সামান্য ঘটনা ঘটলেই বর্তমান সরকারকে দায়ী করা হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক বলেন, কোটা আন্দোলন বলেন, সবকিছুর দায় আমাদের আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর দেওয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ছেড়ে কথা বলছেন না। বলা হয় সব দোষ নাকি ওনার। অথচ ২১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গিয়ে ২৪ জন নিরপরাধ মানুষ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো, কিন্তু তার দায় সেই সময়কার সরকারের ওপর দেওয়া যাবে না! ওই ঘটনার পরে সরকারের আলামত নষ্ট, জজ মিয়া নাটক সাজানো—সব পরম্পরায় যেসব কাজ করেছে তাতে তো সাদা চোখেই স্পষ্ট যে ঘটনার পেছনে সরকারের যোগসাজশ না থাকলে এটা সম্ভব নয়। ওই সরকার নিজেদের আড়াল করার জন্যই তো এসব করেছে। আমাকে অন্য দল, অন্য মানসিকতার মানুষেরাও কিন্তু আমাদের কাছে বলে, এটা হওয়া ঠিক হয়নি।’

ক্ষোভের সঙ্গে তানিয়া বখত বলেন, ‘আমার শুধু একটা কথাই মনে হয়, ১৪ বছর পরেও যারা এ ধরনের মন্তব্য করছেন তাদের আমরা যারা ঘটনার ভিকটিম তাদের জায়গায় বসিয়ে দেখাতে ইচ্ছা করে। আমরা যারা সেদিন কেউ বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়েছি, আমাদের জায়গায় নিজেরা বসলে কিছুটা হলেও অনুভব করবে কেমন লাগে? যে সরকার ক্ষমতায় সমস্ত শাসনযন্ত্র তার। সেই সময় এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো, এর দায় কার?’
ঘটনার পরম্পরা তুলে ধরে আইভি কন্যা বলেন, ‘ঘটনার পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মাকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। ওই সময় হাসপাতালে আমাদের মায়ের পাশে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। দেখতে গেলেই বলতো বের হয়ে যান। দুই মিনিটের বেশি দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমাদের মা চলে যাচ্ছেন। অথচ আমাদের পাশে থাকতে দেয়নি।’
ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা যখন সিএমএইচে আইভি রহমানকে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন ছোট বোনসহ অন্য আত্মীয়দের একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল উল্লেখ করে জিল্লুর রহমানের বড় মেয়ে তানিয়া বলেন, ‘যখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমার মাকে দেখতে গেলেন তখন সেখানে আমার ছোট বোনসহ আত্মীয়-স্বজন ছিল। ওই সময় তাদের একটি রুমে দুই ঘণ্টা আটকে রাখা হলো। এটা কী মানবিক ছিল?’
বিশিষ্ট নারীনেত্রী আইভি রহমানের পুরো নাম বেগম জেবুন্নেছা আইভি। ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব শহরের চন্ডিবের গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। তার বাবার নাম জালাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন গৃহিণী। আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আইভি রহমান পঞ্চম ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ছিলেন। মহিলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পর থেকেই দক্ষতার সঙ্গে পালন করে এসেছেন। দুই দফায় ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও দুই মেয়ের মা। ছাত্রী হিসেবে তিনি মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেছেন।
রাজনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও আইভি রহমান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গেও পারিবারিকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। আইভি রহমান সারা জীবন মাঠের রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক সভামঞ্চে উঠে ভাষণ খুব কম দিয়েছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে মঞ্চের নিচে বসে শুনতে ও স্লোগান দিতেই পছন্দ করতেন বেশি। অথচ সব সময় যেকোনও আসর জমজমাট করে রাখা প্রাণবন্ত মানুষটি গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর তার প্রিয় প্রাঙ্গণ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে খোলা ট্রাকের পাশে পড়েছিলেন একা কিছুটা সময়। ব্যাপক হতাহত ও আতঙ্কের কারণে সবাই চারদিকে প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। তখন স্থির হয়ে ছিল তার দু’চোখ। পরনের কালো পাড়ের সাদা শাড়িটির বেশিরভাগ অংশই ছিল রক্তে ভেজা। কাপড়ের নিচের অংশ পুড়ে ছাই। ডান পায়ের মাংসপেশি দলা হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে ৫২ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু রক্তক্ষরণ ঠেকানো যায়নি। প্রায় চার দিন অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যান তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top