সকল মেনু

জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের ডায়েরি

সাহিত্য ডেস্ক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫ বছরের জীবনের আটটি জন্মদিন কেটেছিল জেলখানায়। তবে এই আটটি জন্মদিনের প্রতিটির বিস্তারিত বর্ণনা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বা সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে নেই। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত জেলে থাকার ঘটনাগুলো তারিখ অনুযায়ী ডায়েরিতে লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে সব ঘটনা নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি। ১৯৬৭ সালে জন্মদিনটি কিভাবে কেটেছিল, তা জেলে বসেই ডায়েরিতে লিখেছিলেন তিনি।

ওই জন্মদিনের তিন দিন আগে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফজিলাতুন্নেসা মুজিব জেল গেটে দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তাই তিন দিন পর আবারও দেখা হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল তার  মনে। আবার বিশ্বাসও ছিল। তিনি লিখেছেন, “মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালোই হতো। ভাবলাম ‘দেখা’ আসতেও পারে।” বঙ্গবন্ধুর ভাবনাকে সত্যি পরিণত করে সেদিন বিকেল পাঁচটায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফজিলাতুন্নেসা মুজিব দেখা করেছিলেন তার সঙ্গে। সঙ্গে এনেছিলেন ফুলের মালা। ওই দিন সিটি আওয়ামী লীগের পাঠানো কেক ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে কেটেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ লেখা ডায়েরিটি ছিল এমন-

“আজ আমার ৪৭তম বার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনও দিনই নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস’! দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালোই হতো। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সঙ্গে দেখা করতে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম-আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিররঞ্জন সুতার একটা রক্ত গোলাপ, বাবু সুধাংশু বিমল দত্ত একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।

আমি থাকি দেওয়ানি ওয়ার্ডে আর এরা থাকেন পুরানা বিশ সেলে। মাঝে মাঝে দেখা হয় আমি যখন বেড়াই আর তারা যখন হাঁটাচলা করেন স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য।

খবরের কাগজ পড়া শেষ করতে চারটা বেজে গেল। ভাবলাম ‘দেখা’ আসতেও পারে। ২৬ সেলে থাকেন সন্তোষ বাবু, ফরিদপুরে বাড়ি। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী দলে ছিলেন, বহুদিন জেলে ছিলেন। এবার মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে জেলে এসেছেন, ৮ বৎসর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রায় ১৭ বৎসর জেল খেটেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল হাসপাতালে প্রায়ই আসেন, আমার সঙ্গে পরিচয় পূর্বে ছিল না। কারণ ভয় তাদের আমি ‘খারাপ’ করে ফেলব, নতুবা আমাকে ‘খারাপ’ করে ফেলবে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ২৬ সেলে যাবেন। দরজা থেকে আমার কাছে বিদায় নিতে চান। আমি একটু এগিয়ে আদাব করলাম। তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধহয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়েছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে। ওর সঙ্গে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।

আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলে মেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও।’

ছয়টা বেজে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না।

ফিরে এলাম আস্তানায়, ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।”

প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গত বুধবার গণভবনে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতে তুলে দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে  বইটি বিক্রি শুরু করেছে বাংলা একাডেমি। প্রথম দিন দুপুর পর্যন্ত শতাধিক কপি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। প্রথম প্রকাশে বইটির ১০ হাজার কপি ছাপানো হয়েছে। মূল্য ৪০০ টাকা হলেও বাংলা একাডেমিতে ৩০ শতাংশ কমিশনে ২৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে বইটি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top