সকল মেনু

টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ম যশোর

mail.google.com যশোর প্রতিনিধি: যশোরে আবারও শুরু হয়েছে টানা বৃষ্টিপাত। সেই সঙ্গে ভারি বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে যশোরের নাগরিক জীবন। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে গোটা জেলার নিম্নাঞ্চলের জনপদ। শহরে ত্রুটিপূর্ণ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারনে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাটও। ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে। সেই সাথে রান্না বন্ধ হয়ে গেছে নিন্মআয়ের মানুষের। রান্নাঘরে পানি ওঠায় শত শত বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে খিচুড়ি রান্না করে ইফতারের সময় সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বর্ষা মৌসুমে শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়া এমন পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া শহরের দক্ষিণাংশের পানি যে হরিণার বিল দিয়ে নিষ্কাশিত হতো, সেখানে পানি নিষ্কাশিত হবার বিকল্প ব্যবস্থা না করে মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস স্থাপন করায় পানি সরতে পারছে না।
পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও কার্যত নির্বিকার পৌর কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, বৃষ্টি থামলেই পানি নিষ্কাশনের কাজ শুরু করা হবে। সপ্তাহখানেক ধরে যশোরে থেমে থেমে আষাঢ়ের বৃষ্টি চললেও গত চারদিন ধরে তা টানাবর্ষণে রূপ নিয়েছে। শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাটও। ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের।
বিমানবাহিনীর যশোরস্থ মতিউর ঘাঁটির আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার রাত থেকেই যশোরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শুক্রবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত যশোরে ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এখানে ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যশোর শহর ঘুরে দেখা গেছে, ভারী বর্ষণে শহরের স্টেডিয়াম পাড়া, বেজপাড়া, বারান্দিপাড়া, বকচর, শংকরপুর, মিশনপাড়া, উপশহর, চাঁচড়া, কারবালা, এমএম কলেজ এলাকা, টিবি ক্লিনিকপাড়া, নাজিরশংকরপুর, বকচর, আরবপুরসহ নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার ড্রেন ছাপিয়ে উপচেপড়া পানি সড়ক পার হয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ভেসে গেছে বিভিন্ন এলাকার পুকুর ও মাছের ঘের। এ মাছ ছড়িয়ে পড়ায় ড্রেন ও সড়কের উপরেই শৌখিন মৎস্যশিকারীদের তৎপরতাও দেখা গেছে।
শহরের বেজপাড়া এলাকার মর্তুজা চৌধুরী জানান, টানা বৃষ্টিপাতের পর পানি তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।তিনি অভিযোগ করেন, বর্ষার সময় ওই এলাকার সড়ক ও ড্রেনের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় পানি চলাচল আটকে দেওয়া হয়েছে। এজন্য পানি নামতে না পারায় গোটা বেজপাড়া এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী জহিরউদ্দিন নান্নু জানান, এমএম কলেজের দু’পাশের গেটেই হাঁটু পর্যন্ত পানি জমেছে। নাগরিকদের অভিযোগ, বর্ষার আগে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার না হওয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় বর্ষাকালে ড্রেন নির্মাণের কাজ চলায় গোটা শহরের পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ড্রেনের পানি উপচে এখন সড়কের ওপরে ঢেউ খেলছে। যশোরে ভৈরব ও কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ইকবাল কবির জাহিদের অভিযোগ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পৌরকর্তৃপক্ষের লুটপাট করার মানসিকতা সর্বোপরি নাগরিক সুবিধাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা শহরের দক্ষিণাংশের সাত নম্বর ওয়ার্ডের। এই ওয়ার্ডের টিবি ক্লিনিক এলাকার জাহাঙ্গীর নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। রাতে শুকনা ঘর দেখে ঘুমিয়ে পড়ি। আর সকালে উঠে দেখি খাঠের নিচে পানি থৈ থৈ করছে। পানি সেচেও শেষ করা যায় না। কারণে শহরের পানির ঢল নামায় দু’একদিন পানিতেই বসবাস করতে হয়।’ একই এলাকার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আর পানি উঠে ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র সব নষ্ট হয়ে যায়।’ জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে কষ্টে রয়েছেন রেললাইন সংলগ্ন চোপদারপাড়া ও জমদ্দারপাড়ার মানুষ। এ এলাকার শতভাগ বাড়ি-ঘরেই এখন হাঁটুপানি। খাটের নিচে ইট দিয়ে কোনোমতে খাটের ওপর বসবাস করছে তারা। রান্নার ঘর ডুবে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে রান্না-বান্না। ফলে মুড়ি খেয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে এ এলাকার শিশু ও বৃদ্ধদের। রহিমা নামে এক গৃহিণী বলেন, ‘রাতে যখন ঘুমাতে যাই তখন ঘর শুকনো ছিল। ভোর রাতে রোজা রাখতে উঠে দেখি ঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে। এরপর খাট উঁচু করে দেই। খাটের পায়ার নিচে চারটি করে ইট দিয়েও এখন পানি খাটের পাটাতন ছুচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, আমরা রোজা থাকলেও ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দুটি রোজা নেই। সকালে রান্না না হওয়ায় মুড়ি আর রুটি কিনে খাইয়েছি। যে অবস্থা তাতে আজ আর রান্না হবে না। ফলে ইফতার ও রাতের খাবার হোটেল থেকে কিনেই খেতে হবে।’আসমা বেগম নামে একই এলাকার এক গৃহবধূ বলেন, ‘আকবরের মোড় এলাকার কয়েকটি বাড়ির লোকজন শংকরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এরপরও যদি বৃষ্টি অব্যাহত থাকে তাহলে তাদেরও আশ্রয় খুঁজতে অন্য এলাকায় যেতে হবে।’
আব্দুল জলিল নামে শঙ্করপুরের এক ব্যক্তি বলেন, ‘শহরের সব পানি এ এলাকা হয়ে হরিনার বিলে গিয়ে পড়ে। কিন্তু ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পানি বের হতে পারছে না। এতে করে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, বেজপাড়া ও শংকরপুর এলাকার মাঝে রেললাইন হওয়ায়ও পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে। রেললাইনের নিচ দিয়ে তৈরি কালভার্টগুলো সরু হওয়ায় পানি বেরুতে পারছে না। এদিকে শংকরপুর ছুটনের মোড়, মধ্যপাড়া, বটতলা মসজিদ এলাকাতেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক জলাবদ্ধতা। এ এলাকার কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গৃহবধূরা খাটের ওপর চুলা বসিয়ে কোনোমতে রান্নাবান্নার চেষ্টা করছেন। অনেক বাড়িতে আবার পানি সেচে বের করতেও দেখা যায়। রহমান নামে এক বৃদ্ধ জানান, এ এলাকার তিন-চার শতাধিক বাড়িতে পানি উঠেছে। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট জুলফিকার আলী জুলু বলেন, ‘শুধু তার এলাকা নয়, ছয় ও আট নম্বর ওয়ার্ডের হাজার হাজার মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আগে পানি বের হতো হরিণার বিল দিয়ে। কিন্তু এখন পানি বের হওয়ার জায়গায় মেডিকেল কলেজ ভবর করায় বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারছে না। যেসব বাড়িতে রান্নাঘরে পানি ঢুকে রান্না বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের খিচুড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে সীমিত পরিসরে।’ তিনি বলেন, ‘আগের মতো যদি ঈদের আগে ৩০০ কার্ড (ভিজিএফ) পাওয়া যেতে তবে এই এলাকার ৫০০ মানুষকে সহযোগিতা করা সম্ভব হতো। এবার আমি আমার ওয়ার্ডের জন্যে পেয়েছি মোটে ১৬০টি কার্ড।’ তিনি জানান, স্থানীয় লোকদের সহায়তায় মানুষজনকে খাবারের সামান্য ব্যবস্থা করা গেছে। আর পানি নিষ্কাশনে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চার নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিল মোস্তাফিজুর রহমান মুস্তা জানান, তার ওয়ার্ডের মধ্যে ভৈরব নদের ধারে বসবাসরত জলাবদ্ধ মানুষের জন্যে খিচুড়ি রান্না করা হচ্ছে। ইফতারের আগে তা বিতরণ করা হবে।এ ব্যাপারে যশোর পৌরসভার সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুম জানান, পৌর এলাকার ড্রেন সংস্কার ও নির্মাণের কাজ চলায় কোনো কোনো এলাকায় পানি নিষ্কাশনে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে, বৃষ্টি থেমে গেলে দ্রুতই পানি সরিয়ে ফেলার জন্য তারা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top