সকল মেনু

আজ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস

unnamed   ইকবাল হোসেন, রংপুর ব্যুরো: আজ শনিবার রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পৃথিবীর  ইতিহাসকে অবাক করে দেওয়ার মত ঘটনা ঘটল রংপুরের  মাটিতে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করা হল লাঠি, বল¬¬ম আর তীর ধনুক নিয়ে।  দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করছে।২৫ মার্চের কালো রাতে দেশজুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সে বিক্ষুব্ধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই চলছিল এর প্রস্তুতি। জেলার শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে ইপিআর বাহিনীর কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী সিপাই ও অফিসারের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ চলতে থাকে এবং সিদ্ধান্ত হয় আক্রমন করে অবাঙ্গালী সৈন্যদের বন্দি করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করা। ওই পরিকল্পনা ও বাঙ্গালী সৈন্যদের গোপনে সংগঠিত করার জন্য মৃত্যুর ঝঁকি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে বসে যিনি কাজ করছিলেন তিনি হলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ (পরবর্তীতে তাকে কারাগারে ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়)। এছাড়াও  ক্যান্টনমেন্ট ওয়ারলেস অপারেটর নূরুজ্জামান ও ইপিআর বাহিনীসহ ট্যাঙ্ক ডিভিশনের বাঙ্গালী সৈন্যরাও এতে সহযোগিতা করেছিল। সে সময়ের মুক্তিযুদ্ধে যারা রংপুর অঞ্চলের সংগঠক ছিলেন তারা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী। সবাই তখন রংপুরের মানুষের ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে  যাচ্ছিলেন।
মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে ধীরে ধীরে রংপুর হয়ে ওঠে উতপ্ত। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস। ওই দিনের পূর্ব রাতে সংগ্রাম কমিটি গঠন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা ব্যস্ত ছিলেন কি করে  মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া যায় তার নানা কলা কৌশল নিয়ে। ২৩ মার্চ মানুষের বিক্ষোভের শিকার হলেন তৎকালীন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট কর্মরত অবাঙ্গালী আর্মি অফিসার আব্বাস ও তার সঙ্গে আরো কয়েকজন সৈন্য। সেদিন শহরের অদুরে ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী নিসবেতগঞ্জর কাছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আমজাদ হোসেনের বাড়ির কিছু দুরে নিচু জমিতে কৌশলে জিপ গাড়ি ফেলে দিয়ে আর্মি অফিসার আব্বাসকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে শাহেদ আলী নামে এক কসাই এবং লুট করে নেয় তাদের অস্ত্র ।
অবাঙ্গালী অফিসার আব্বাস গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন নিসবেতগঞ্জ বাজারে । সেখান থেকে ফেরার পথে লোকজন কৌশলে তার গাড়ি থামিয়ে ওই ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনার পর রংপুরে পাকিস্তান সৈন্যরা আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা তৈরি করে বাঙ্গালী গনহত্যার নীল নকশা। রাজাকার আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় তারা মেতে ওঠে গনহত্যায়। শুরু করে বাঙ্গালির উপর নির্যাতন।
এ ঘটনার পরদিন ছিল ২৪ মার্চ মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম নিসবেতগঞ্জ, দামোদরপুরে পাক সেনাদের হত্যাযজ্ঞ চলে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। একই সঙ্গে ৩২ জনকে দড়ি দিয়ে বেধে পরের দিন জুম্মার নামাজের সময় লাহিড়িরহাটের কাছে একটি মাঠে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।  এরপর মানুষের বিক্ষুব্ধতা আরো বেড়ে যায়। সেদিন এই বিক্ষুব্ধ মানুষকে সংগঠিত যারা করেছিলেন তারা হলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আমজাদ হোসেন, মজিবর হোসেন মাষ্টার, মরহুম সিদ্দিক হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুল গনি, তৈয়বুর রহমান, আবদুল আউয়াল টুকু, ন্যাপ নেতা শামসুজ্জামান, কমিউনিস্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরো অনেকে।
শেখ আমজাদ হোসেন বলেন, সে সময় ক্যান্টনমেন্টের ওয়ারলেস অপারেটর নুরুজ্জামান সব খবর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের পৌছে দিতেন কর্নেল ডা. এম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর রংপুর ট্যাঙ্ক ডিভিশন সৈন্যরা ছিল প্রায় সবাই বাঙ্গালী। এদের সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ ছিল। এসব নিয়ে গোপন বৈঠক বসত শহরের কামালকাছনায় এবং ক্যান্টনমেন্টের পাশে হেলিপেড প্রাইমারী স্কুলসহ শহরের বেশ কয়েক জায়গায়।  ২৮ মার্চ দুপুরের পর থেকেই রংপুরের  মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, শ্যামপুর, পালিচড়া, বদরগঞ্জ, তামপাট, বুড়িরহাট হারাগাছ, পাগলাপীর,তারাগঞ্জ থেকে হাজারো জনতা ক্যান্টমেন্টের দিকে আসতে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের মিছিলের সম্মুখ ভাগে ছিল মিঠাপুকুর উপজেলা উপজাতি সাওতালরা। তারা তীর, ধনুক, বল¬ম নিয়ে হানাদার বাহিনীকে খতম করার জন্য ক্যান্টমেন্টের দিকে যেতে থাকে। আগ্নেয়গিরির  মত উত্যপ্ত জনতাকে সেদিন কেউ ফেরাতে পারেনি। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করে। ঠিক সে সময় পাক সৈন্যরাও ১০টি জীপে মেশিনগান প্রস্তুত করে চালাতে থাকে গুলি। প্রায় ৫ মিনিট চলে বৃষ্টির মত অবিরাম গুলি। পাখির মত লুটিয়ে পড়তে থাকে জনতা। গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়া মানুষগুলোর আত্মচিৎকারে ঢেকে গেল চারদিকের অন্যসব কোলাহল। এক সময় দেখা গেল লাশের পর লাশ পড়ে আছে সব জায়গায়। প্রায় এক হাজার  মানুষ সেদিন হানাদারের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছিল। তাদের রক্তে মাঠের সবুজ ঘাস ও পার্শ্ববর্তী  ঘাঘট নদীর পানি হয়ে যায় লাল। ব্যর্থ হল বিক্ষুব্ধ জনতার ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসুচি। ক্লান্ত শরীরে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে ফিরে গেল জনতার স্রোত। ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে আসে। পশ্চিম আকাশে যেন সেদিনের শত শহীদের রক্তের আবির ছুইয়ে আরো গাঢ় লাল হল সূর্য ,সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে নিঝুম আধারে। ওই আধারেই লাশগুলো পাকিস্তানী সৈন্যরা জড়ো করে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়। তাদের স্মরনেই ২০০০ সালের ১৭ ফেব্রয়ারী সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান নিসবেতগঞ্জ এলাকায় রক্ত গৌরব নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।
এদিকে, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্মৃতিস্তম্ভ রক্ত গৌরবে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসুচি পালন করছে। রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ রক্ত গৌরবে পুষ্পমাল্য অর্পন করে। এসময় সেখানে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, মহানগর সভাপতি সাফিউর রহমান, সাধারন সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল, জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক তৌহিদুর রহমান টুটুল, নাজমুল ইসলাম ডালিম, জেলা ছাক্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান রনি, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম সাব্বির, মহানগর ছাত্রলীগনেতা আজিজ, রফিকুল, ইউনুস প্রমুখ। এছাড়া জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিণœ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top