সকল মেনু

নিষিদ্ধ সত্ত্বেও আমদানি হচ্ছে টিভির পুরনো পিকচার টিউব, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ঠকছেন ক্রেতারা

indexঅর্থনৈতিক প্রতিবেদক : নিষিদ্ধ ঘোষিত পুরনো ও ব্যবহৃত সিআরটি টিভির পিকচার টিউব আমদানি এখনো বন্ধ হয়নি। অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে এ ধরনের পিকচার টিউব আমদানি করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় শিল্পউদ্যোক্তা ও ভোক্তারা। অন্যদিকে এটি স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এ অবস্থায় পুরনো পিকচার টিউব যাতে দেশের বাজারে প্রবেশ করতে না পারে সেবিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিকচার টিউব ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র সিআরটি (ক্যাথড রে টিউব) টেলিভিশন তৈরিতে। আগে বিভিন্ন দেশে এই পিকচার টিউব তৈরি হলেও বর্তমানে কেবল চীনের একটি প্রতিষ্ঠান টিজিডিসি এটি তৈরি করছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার আশায় স্বল্পমূল্যে পুরনো এবং ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি করছে। এরফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত টিভি উৎপাদন ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে স্বল্পমূল্যে পুরনো পিকচার টিউবযুক্ত টিভি সেট কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা।
বাংলাদেশের আমদানি নীতি আদেশ ২০১২-১৫-এর অন্তর্ভুক্ত আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকার ফুটনোট (৪) এ পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ১৫, ১৬ ও ৩২- ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে উল্লেখ রয়েছে। একই আইনের ধারা ১৫৬(১)-এর ক্লজ ৯ অনুযায়ী এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ রয়েছে, পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব দিয়ে সনি, স্যামসাং, এলজিসহ নামি-দামি ব্র্যান্ডের লোগো ব্যবহার করে নকল টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে। পণ্যমান যাচাই না করে বিদেশী ব্র্যান্ডের লোগো এবং স্বল্পমূল্য হওয়ায় এসব টিভি কিনে ক্রেতারা হচ্ছেন প্রতারিত। প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত ব্র্যান্ড কয়েক বছর আগেই সিআরটি টিভি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
চিকিৎসাবিদদের মতে, পুরনো পিকচার টিউব হলো এক ধরণের বিষাক্ত পদার্থ। এসব দিয়ে তৈরি করা টেলিভিশন থেকে নির্গত গামা রশ্মি দেহ ও চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে পুরনো পিকচার টিউবের অতিবেগুনি রশ্মি ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পরিবেশ বিপর্যয়ে ভূমিকা রাখে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে যেসব স্থানীয় উদ্যোক্তা টেলিভিশন সংযোজন ও উৎপাদন কারখানা গড়ে তুলেছেন তারা স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। একদিকে তারা বাজার হারাচ্ছেন, অন্যদিকে তাদের বিনিয়োগও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। গত এক দশকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে তানিন, নিপ্পন, প্যাসিফিক, ন্যাশনাল, এনইসি, নিক্কনসহ অনেক ব্র্যান্ডের টেলিভিশন প্রস্তুতকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর সভাপতি মফিজুর রহমান বলেন, কাস্টম কর্মকর্তাদের নজর এড়িয়ে বর্তমানে গুটিকয়েক অসৎ ব্যবসায়ী পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি করে বিভিন্ন ব্রান্ডের নামে নকল টেলিভিশন প্রস্তুত করে বাজারে কম দামে বিক্রি করছে। ফলে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। আবার যেসব উদ্যোক্তা টেলিভিশন কারখানা স্থাপন করেছেন তারাও মারাত্বকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
নতুন পিকচার টিউব কিনতে হয় প্রতিটি ২৯ মার্কিন ডলার বা তার চেয়েও বেশি দামে। অন্যদিকে পুরনো পিকচার টিউবের দাম ১০ ডলারেরও কম। যেহেতু পুরনো ও ব্যবহৃত পিকচার টিউব আমদানি নিষিদ্ধ তাই সেগুলো নতুনগুলোর সমান দাম দেখিয়েই বন্দর থেকে ছাড় করাতে হয়। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশে টাকা পাচার করছেন। বর্তমানে পিকচার টিউব আমদানিতে ৩৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।
তবে, এখনো এই অসম প্রতিযোগতার মধ্যেও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ওয়ালটন, মার্সেল, টিসিএল, মাইওয়ান, কনকা, গোল্ডস্টার ও সোলার ব্রান্ডের টেলিভিশন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
বন্দর ও কাস্টমসের তথ্যমতে- গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড়করণের জন্য ২০টি চালানের বিপরীতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট শুল্ক বিভাগে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আটটি চালান পুরনো ও ব্যবহৃত প্রমাণিত হওয়ায় নভেম্বর মাসে সংশ্লিষ্টদের কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিস দিয়েছে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। পুরনো পিকচার টিউব ছাড়করণে সম্প্রতি শুল্ক কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ির ফলে এলসি খোলার পরও তা বাতিল করেছেন অনেকে। সর্বশেষ তথ্যমতে, গত অক্টোবর মাসে পিকচার টিউব আমদানি হয় ৬৬,৯৩৮.৮ টন। নভেম্বর, ডিসেম্বরে খালাস বন্ধ থাকলেও জানুয়ারিতে আমদানি করা হয় ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪৪.৪ টন।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর পিকচার টিউব আমদানিতে ল্যাব টেস্ট এবং শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে শুল্কায়নের নিদের্শনা দেয়। কিন্তু এই ল্যাব টেষ্ট বাধ্যতামূলক না করায় অসাধু ব্যবসায়ীরা পুরনো পিকচার টিউব আমদানি অব্যাহত রেখেছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ল্যাব টেস্টিং শতভাগ বাধ্যতামূলক করা উচিত। সেক্ষেত্রে আমদানিকারক বা তার প্রনিধির মাধ্যমে নয়, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যেন সরাসরি নিজেরাই ল্যাব টেষ্ট করে। বিশেষ করে প্রস্তাবিত আমদানি নীতিতে (২০১৫-২০১৮) ল্যাব টেস্ট বাধ্যতামূলক রাখার পক্ষে তারা।
কমলাপুর আইসিডি কাস্টমসের জয়েন্ট কমিশনার মিয়া মোঃ আবুওবায়দা বলেন, পিকচার টিউব ছাড়করনের ক্ষেত্রে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। অবশ্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. মাসুদ সাদিক জানান, নতুন ঘোষনা দিয়ে পুরনো পিকচার টিউব আমদানির কারণে কিছু আমদানিকারককে ইতিমধ্যে শোকজ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, কাস্টমস আইন অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পুরাতন পিকচার টিউব নিলামে বিক্রি করারও সুযোগ নেই। এগুলো ধ্বংস করতে হয়।
এফবিসিসিআই পরিচালক মহব্বত উল্ল্যাহ নিষিদ্ধঘোষিত পুরনো পিকচার টিউব আমদানির তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য কাস্টম হাউসগুলোকে অবশ্যই আমদানিকৃত পিকচার টিউব ছাড়করনের আগে এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী বুয়েট অথবা সরকার স্বীকৃত কোনো টেস্টিং ল্যাব থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। টেস্টিং সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেই পণ্য ছাড়ের অনুমতি দিতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তারাও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে তাদের বিনিয়োগ হারাবেন। তিনি এবিষয়ে এনবিআর এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে আরো কার্যকর ভূমিকা নেয়ার দাবি জানান।
বাংলাদেশ টিভি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ১৯৯৫ সালের পর থেকে সাদা-কালো টেলিভিশন সংযোজনের মাধ্যমে দেশে টেলিভিশন সংযোজন শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যে দেশে অর্ধশত ব্র্যান্ডের সংযোজন কারখানা গড়ে ওঠে। পরে রঙিন টিভির চাহিদা বাড়লে ২০০৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে আরো ৭৫টি উৎপাদন ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান। তবে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগই ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সংযোজনসহ বার্ষিক প্রায় ১২-১৩ লাখ টেলিভিশন উৎপাদন হয়। আমদানি হয় আরো ২ লাখের মতো। গত বছর ১৫ লাখের বেশি টেলিভিশন বিক্রি হয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১৫০০ কোটি টাকার বেশি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top