সকল মেনু

সৈয়দপুরের আটকেপড়া বিহারীরা ক্যাম্পের দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি চায়

Bihari Campমো. আমিরুজ্জামান, নীলফামারী প্রতিনিধি : আর উদ্বাস্ত হয়ে মানবেতর জীবন চাইনা। এবার সত্যিকার বাংলাদেশি হয়ে সমাজের মুলধারায় ফিরে আসতে চাই- এমনই কথা বলেছেন নীলফামারীর সৈয়দপুরে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা। ক্যাম্পের দুঃসহ জীবন থেকে তারা মুক্তি চায়। সূত্র জানায়, নীলফামারীর বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুরে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের (বিহারী) ২২টি ক্যাম্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গোলাহাট সিনেমা হল ক্যাম্প, রসুলপুর ক্যাম্প, মুন্সিপাড়া ক্যাম্প, মোস্তফা ক্যাম্প, উত্তর নিয়ামতপুর চামড়া গুদাম ও দক্ষিণ নিয়ামতপুর চামড়াগুদাম ক্যাম্প, আউট হাউস ক্যাম্প, হাতিখানা ক্যাম্প, দুর্গামিল ক্যাম্প, নয়াবাজার ধর্মশালা ক্যাম্প, সুড়কি মহল্লা ক্যাম্প, বাঁশবাড়ি ক্যাম্পসহ এসব ক্যাম্পে প্রায় ৪০ হাজার বিহারীর বসবাস।
সূত্র মতে, মুক্তিযুদ্ধে বিহারীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে। বিহারীদের অনেকেই সেসময় যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং বাঙালি হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। ফলে দেশ স্বাধীন হলে ওই বিহারীরা নিজেদের পাকিস্তানি দাবি করে সেদেশে প্রত্যাবসনের প্রহর গুণতে থাকে। ১৯৭২ সালে প্রায় ৫ লাখ বিহারী পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের জন্য নিজেদের নাম নিবন্ধিত করে। তবে এর বাইরেও কয়েক লাখ বিহারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাসের উদ্যোগ নেয়। এই সৈয়দপুর শহরেও ক্যাম্পের বাইরেও প্রায় লক্ষাধিক বিহারী স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। যারা সমাজের মুলধারায় মিশে গিয়ে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভূমিকা রাখছে। উত্তরের অবাঙালি অধ্যুষিত এই শহরের বিহারীরা ভাঙা-ভাঙা শব্দে বাংলাকে বুকে লালন করছে। এসব পরিবারের সন্তানরা বাংলায় লেখাপড়া করে দেশ-বিদেশে কর্মরত রয়েছে এবং শহরের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধা তালিকাতেও রয়েছে তারাই।
আটকেপড়া পাকিস্তানি ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, শহরের ২২টি ক্যাম্পে আটকেপড়া বিহারী ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরে বসবাসরত মানুষদের ইচ্ছেও তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষার দিকে এগিয়ে নেয়ার। কিন্ত আর্থিক দৈন্যতার কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে পড়াতে পারছে না। সাবেক এমপি ও ভাষা সৈনিক আলিম উদ্দিন জানান, বাঙালি ও বিহারীদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই এখন সৈয়দপুরে। বাঙালি- বিহারীদের মধ্যে বিয়ে- শাদিসহ বিভিন্ন আত্বীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠছে। তার মতে , বিহারী ও বাঙালির মতনৈক্য না থাকার কারণে সৈয়দপুর এখন শিক্ষা নগরী। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের একটি সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পাকিস্তানে ১ লাখ ১৮ হাজার বিহারী প্রত্যাবাসন হয়েছে। ৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর ওই প্রত্যাবাসন ধারা থেমে যায়। সেই থেকে বিহারীরা সৈয়দপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকার বিভিন্ন ক্যাম্পে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ১৯৯২ সালে পাকিস্তান ফিরে যেতে ইচ্ছুকদের খুঁজে বের করতে একটি জরিপ চালানো হয়। সেসময় পাকিস্তান সরকার ৩২৩ জন মানুষকে ফিরিয়ে নেয়ার পর আর কাউকেই ফিরিয়ে নেয়নি।
00000নীলফামারী জেলার ঘনবসতিপূর্ণ সৈয়দপুরে বিহারী ক্যাম্প রয়েছে ২২টি। এসব ক্যাম্পের বেশির ভাগই ঘরই বেড়া বা ছনের ক্যাম্পের ঘরের ভেতর ঢুকলে মন খারাপ হয়ে যায়। থাকার ঘর, রান্নাঘর ও গোসলখানা একাকার। আলমারির বদলে বস্তায় কাপড়-চোপড় ভরে রাখা। আট ফিট বাই আট ফিট ঘরে তিন প্রজম্ম একসঙ্গে বসবাস করছে। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জীবন বাঁচার তাগিদে কেউ রিকশা চালায়, ফেরি করে, হোটেল- রেস্তোঁরায় শ্রমিকের কাজ করে, মহিলারা জরি-কারচুপির কাজও করে থাকে। অনেকে আবার অপরাধ কর্মকান্ডেও জড়িয়েছেন। ক্যাম্পবাসীরা জানায়, আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে, কিন্ত পাসপোর্ট করতে গেলে নানা অসুবিধা। আগে খাদ্য সহায়তা দেয়া হলেও তা অনেকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। তবে ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল সরকারিভাবে দেয়া হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোর স্যানিটেশন অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এখানে প্রবেশ করতে হলে নাকে ও মুখে রুমাল দিতে হয়।
এই আটকেপড়া পাকিস্তানি ক্যাম্পের ভোটাররা সৈয়দপুরের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্ত তারা কোন নাগরিক সুযোগ- সুবিধা পাচ্ছে না। আটকেপড়া পাকিস্তানি সাধারণ প্রত্যাবাসন কমিটির (এসপিজিআরসি) সৈয়দপুর শাখার সভাপতি রেয়াজ আকবর জানান, আমরা দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছি। সৈয়দপুরের বিহারী ক্যাম্পগুলো খুবই জরাজীর্ণ। ইতোমধ্যে মুন্সিপাড়ায় অবস্থিত একটি ক্যাম্পের ছাদ ধসে পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ঝড়- বৃষ্টিতে ক্যাম্পবাসীদের দুর্দশার সীমা থাকে না। বিহারীদের মাসিক খাদ্য বরাদ্দ বিগত ২০০৬ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে মহামান্য হাইকোর্ট ক্যাম্পবাসী বিহারীদের ভোটাধিকারের রায় প্রদান করেছেন।
এক এক করে ৪৪টি বছর পেরিয়ে গেলেও আটকেপড়া পাকিস্তানি ইস্যুটির আজ পর্যন্ত কোন সমাধান হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও এ সমস্যা সমাধানে কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এনিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই্ শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আটকেপড়া কয়েক প্রজম্ম মানবেতর জীবন-যাপন করে যাচ্ছে প্রায় তিন লাখ উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী।
আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সমস্যা সম্পর্কে সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ মো. আমজাদ হোসেন সরকার বলেন, ১৯৭১ সালের পর যার জন্ম তিনিও এখন বিয়ে করে ঘর সংসার করছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বন্ধন গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। গড়ে উঠেছে জীবিকার যোগসূত্র। বর্তমানে এ জনগোষ্ঠীর কেউই আর পাকিস্তান যেতে চায় না, সবাই বাংলাদেশে থাকতে চায়। তিনি বলেন, একটি এনজিও প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাম্পগুলোর স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করবে। এমনিভাবে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অটকেপড়া পাকিস্তানিদের পূনর্বাসনে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। মুল জন¯্রােত থেকে বাইরে থাকা উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণ ও আর্থিক অনটন ঘোচাতে এবং তারা যে এদেশের নাগরিক তা বোঝাতে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরী- মন্তব্য সচেতন মহলের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top