সকল মেনু

গ্রামীণ আদালতে বঞ্চিত নারীরা

35255_1হট নিউজ ডেস্ক : মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই নারীদের। এ কারণে তারা গ্রামীণ আদালতে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর পরও আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা ও অর্থের কথা চিন্তা করে গ্রামীণ আদালতের দারস্থ হতে হয় নারীদের। এই সুযোগে স্থানীয় কতিপয় অসাধু লোক নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেন।

প্রাচীন আমল থেকেই বিচারিক আদালতের পাশাপাশি গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে গ্রামীণ সমস্যা সমাধানের রীতি চলে আসছে। গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ থানা-কোর্টে গিয়ে তাদের নানাবিধ সমস্যার সমাধান পান না।
তাছাড়া থানা বা আদালতের রয়েছে দীর্ঘসূত্রীতা। একটি মামলা বছরের পর বছর পেইন্ডিং থেকে যায়। বিবাদী পক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলার স্থগিতাদেশ আনতে সক্ষম হন। এ ক্ষেত্রে বাদির অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকে। আর বাদী যদি হন নারী, তবে হয়রানীর মাত্রা আরও বাড়তে পারে।

এসব প্রতিকূলতার কথা চিন্তা করেই অধিকাংশ নারীরা গ্রামীণ সালিসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। ফলে নারী নির্যাতন, যৌতুক সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে নারীদেকে গ্রাম্য সালিসের কাছে যেতে হয়। কিন্তু বর্তমানে গ্রাম্য সালিস স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিস্বার্থ ও দুর্নীতির অভায়রণ্যে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া এসব সালিসে নারীদের অংশগ্রহণও কমে গেছে।
অন্যদিকে সালিস ব্যবস্থা সম্পর্কে নারীদের ধারণা নেই বললেই চলে। এই সুযোগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পক্ষপাতিত্বমূলক রায় দিয়ে থাকেন। অনৈতিক এ কর্মকাণ্ডের দৌরাত্ব বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি গ্রামের নারীরা যেমন ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি গণ্যমাণ্য ব্যক্তিরাও আর সালিসে জড়াতে চান না।

সালিসের পটভূমি
সালিস অর্থ মধ্যস্থতা। এটা ফারসি শব্দ। জমিদারি প্রথা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। স্থানীয় সরকারের পরিবর্তিত রুপ হচ্ছে সালিস ব্যবস্থা। আগে জমিদাররা তাদের কাচারিতে এসব বিচার ব্যবস্থা চালাতেন। এখন সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা এলাকার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের দ্বারা সালিস হয়ে থাকে। সমাজে সৌহার্দ-সম্প্রীতি এবং সহযোগীতার মনোভাব গড়ে তুলতে সালিসী ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম৷

অচলনামা ও রোয়েদাদ
সালিসের পূর্বে সাদা কাগজে বাদী/ বিবাদীর অঙ্গীকার নেয়া হয়। এতে বলা থাকে বিচার যা-ই হোক তা মেনে নেয়া হবে। এই অঙ্গীকারপত্রকেই বলা হয় অচলনামা। বিচার শেষে রায় লিখে উভয় পক্ষের সম্মতি নেয়া হয়। এটাকে বলা হয় রোয়েদাদ। এই রোয়েদাদকে আদালতেও গুরুত্ব দেয়া হয়। গ্রাম্যসালিসের মাধ্যমে মিমাংশা হলে আদালতের চেয়ে সময় ও অর্থের ব্যয় কম হয়। পারিবারিক পরিবেশে নারীদের বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে।

সালিস হওয়ার নিয়ম
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ – ১৯৬১ তে সালিসী ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে- সালিসী ব্যবস্থা হলো ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় তালাক, বহুবিবাহ ও খোরপোষ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার জন্য একটি ক্ষমতাবান আইনগত পরিষদ৷ এক্ষেত্রে সালিসী ব্যক্তি কোনো বিচারক নন এবং তিনি কোনো আইন প্রয়োগও করেন না৷ শুধুমাত্র তিনি বিবাদরত দুই দলকে মীমাংসায় পৌঁছাতে আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন মাত্র৷ কিন্তু বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সালিসী ব্যবস্থায় কাউকে কোনোরূপ শাস্তি দেওয়া যাবে না বা দোষী করা যাবে না৷ বিশ্বাস ভংগ করা যাবে না এমনকি এরূপ প্রতিশ্রুতি করা যাবে না যা কখনো কার্যকর করা সম্ভব নয়৷

সালিস পরিষদ গঠন
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা পৌরসভার চেয়ারম্যান অথবা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র বা প্রশাসক অথবা মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ – ১ঌ৬১ অনুযায়ী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে এবং বিবাদরত পক্ষসমূহের প্রত্যেক পক্ষের একজন করে প্রতিনিধিসহ মোট ৩ জন নিয়ে সালিসি পরিষদ গঠন করা হবে৷ প্রয়োজনে একাধিক সালিসদার নিয়োগ করা যেতে পারে৷ সালিসদার ব্যক্তি অবশ্যই একজন নিরপেক্ষ ও জ্ঞানী ব্যক্তি হবেন৷

সালিসী পরিষদের প্রতিনিধি মনোনয়ন
চেয়ারম্যানের নিকট বহুবিবাহের অথবা খোরপোশের দরখাস্ত পেশ করা হলে অথবা তালাকের নোটিশ এলে তিনি উভয় পক্ষকে এই মর্মে নোটিশ দিবেন যে , এই নোটিশ পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে প্রত্যেকপক্ষ লিখিতভাবে নিজ নিজ প্রতিনিধির নাম মনোনিত করে হাতে হাতে বা রেজিস্ট্রি ডাক যোগে চেয়ারম্যানের নিকট জমা দিবেন ৷ কোনো পক্ষ যদি প্রতিনিধি মনোনিত করতে ব্যর্থ হয় তবে ঐ প্রতিনিধি ছাড়াই সালিস পরিষদ গঠিত হবে৷

কোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমুসলিম হলে অথবা অন্যকোন কারণে দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছা প্রকাশ না করেন , সেক্ষেত্রে ঐ ইউনিয়ন অথবা পৌরসভা হতে একজন মুসলিম সদস্য সালিসী পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন৷
চেয়ারম্যান নিরপেক্ষ না হলে

যদি কোন পক্ষের নিকট মনে হয় যে, চেয়ারম্যান অন্য পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন তবে উক্ত পক্ষ অন্য চেয়ারম্যান নিযুক্তির জন্য নির্ধারিত ব্যক্তির ( জেলা প্রশাসক অথবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ) নিকট যুক্তিসংগত কারন উল্লেখ করে লিখিত আবেদন করতে পারবেন৷ তিনি (নির্ধারিত ব্যক্তি ) যুক্তিসংগত মনে করলে ঐ পরিষদের অন্য কোন মুসলিম সদস্যকে সালিসী পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতে পারবেন৷
প্রতিনিধি পরিবর্তন করতে চাইলে

মনোনিত প্রতিনিধি যদি মারা যান, অসুস্থ হন বা অন্য কোন কারণে সালিসী বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন কিংবা পরে ঐ বৈঠকের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন, সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের পূর্ব অনুমতি নিয়ে পূর্বের মনোনয়ন বাতিল করে নূতন প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারবেন৷ এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান কর্তৃক মঞ্জুরকৃত সময়ের মধ্যে নতুন প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে হবে৷
সালিসী পরিষদের এখতিয়ার

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ – ১ঌ৬১ তে সালিসী পরিষদের এখতিয়ার সম্পর্কে বলা আছে ৷ সে মতে তালাক , বহুবিবাহ ও খোরপোষ সংক্রান্ত বিরোধসমূহের মীমাংসা সালিসী পরিষদ করতে পারবে৷
তালাক

তালাকের নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান উভয়পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে সালিসী পরিষদ গঠন করবেন৷ সালিসী পরিষদ উভয়পক্ষকে ডেকে সমঝোতার চেষ্টা করবেন৷ সমঝোতার চেষ্টা সফল হতে পারে, আবার ব্যর্থ হতে পারে৷ সমঝোতার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী মিলে গেলে তালাক কার্যকরী হবে না৷ তবে সালিসী পরিষদের মাধ্যমে কোন উদ্যোগ নেয়া না হলে নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন পর তালাক কার্যকরী বলে গণ্য হবে৷
খোরপোষ

আইনগত অন্য বিধান থাকা সত্বেও স্ত্রী খোরপোষ দাবি করে স্বামীর বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে পারবেন৷ আবেদন পাওয়ার পর চেয়ারম্যান স্ত্রী এবং স্বামী উভয় পক্ষের মনোনীত একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সালিসী পরিষদ গঠন করবেন৷ সালিসী পরিষদ স্ত্রীর দাবির যুক্তি, উভয়পক্ষের সামাজিক অবস্থান যাচাই করে খোরপোষের পরিমাণ নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত দেবেন এবং সে মোতাবেক একটি সার্টিফিকেট প্রদান করবেন৷ সিদ্ধান্ত মোতাবেক খোরেপাষ এর জন্য নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ না করলে তা বকেয়া ভূমি রাজস্ব আদায়ের মতো আদায়যোগ্য হবে৷
বহুবিবাহ

বহুবিবাহ করার জন্য কেউ চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করলে চেয়ারম্যান স্ত্রী এবং স্বামী উভয় পক্ষের পছন্দ মত একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সালিসী পরিষদ (Arbitration Council) গঠন করবেন৷ সালিসী পরিষদের কাছে স্বামীর আর একটি বিবাহ করার ইচ্ছা ন্যায়সঙ্গত মনে হলে তারা স্বামীকে বহুবিবাহ করার জন্য তারিখ ও স্মারক নং সহ লিখিত অনুমতিপত্র দেবেন৷ তবে বহুবিবাহের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে সালিসী পরিষদ যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনবেন সেগুলো হলো :
১.বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব
২.শারীরিক মারাত্বক দূর্বলতা
৩.দাম্পত্য জীবন পালনে অক্ষমতা

এছাড়াও মানসিকভাবে অসুস্থতা এবং আদালতের নিকট গ্রহণযোগ্য অন্যান্য কারণ ইত্যাদি৷
বিনা অনুমতিতে বহুবিবাহ করলে

কোন ব্যক্তি যদি সালিসী পরিষদ এর অনুমতি ব্যতিত উল্লেখিত আইনগত পদ্ধতি লংঘন করে বহুবিবাহ করে তাহলে স্ত্রী আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন৷ স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে স্বামীর একবছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ড হবে৷ প্রয়োজন মনে করলে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারেন এবং বকেয়া সম্পূর্ণ দেনমোহরের টাকা ভূমি রাজস্ব রূপে আদায়যোগ্য হবে৷

এর বাইরে ছোট-খাট ঝগড়া-বিবাদ ব্যতীত অন্য কোন বিরোধ মীমাংসা করার ক্ষমতা সালিসী পরিষদের নাই৷

যেসব বিষয়ে সালিসী করা যাবে না

বাংলাদেশ ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৫ নং ধারা অনুযায়ী অনেকগুলো গুরুতর অপরাধ সালিসীতে মীমাংসা করা যাবে না৷ এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে :১৷ যে কোনো কারণে সংঘটিত হত্যাকান্ড
২৷ ধর্ষণ
৩৷ অপহরণ
৪৷ ডাকাতি এবং
৫৷ আরও বিভিন্ন গুরুতর অপরাধ৷

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top