সকল মেনু

তিরানব্বই বছরে এসেও জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন বিজয় চন্দ্র দে

Chandpur Teacher Bijoy Candro Day,03শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর প্রতিনিধি : দীর্ঘ ৬৬ বছর ধরে শিক্ষকতার মাধ্যমে আলোকিত মানুষ গড়ে যাচ্ছেন চাঁদপুরের ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিজয় চন্দ্র দে। তার বর্তমান বয়স ৯৩ বছর। এখনো তিনি নিয়মিত ক্লাশ করিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এভাবেই আলো ছড়িয়ে দিয়ে যেতে চান।
বিজয় চন্দ্র দে’ ১৯২২ সালে চাঁদপুর সদর উপজেলার ফরক্কাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম  গোবিন্দ্র চন্দ্র দে, মা সরোজনী দে। বাবা মারা গেছেন ৪৮ বছর আগে আর মা ৪০ বছর আগে। বাবা ছিলেন একজন গৃহস্থ। মা গৃহিনী। ৩ ভাই ৪ বোনের তিনি সবার ছোট। তিনি ছাড়া তার ভাই বোনের কেউ এখন বেঁচে নেই।
ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাস করেন। শিক্ষক হওয়া তার জীবনের লক্ষ্য ছিলো না। পড়াশোনা শেষ হলে বাবা বললেন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে। বললেন, শিক্ষকতা পেশায় মানুষজনের যে সম্মান, শ্রদ্ধা তা অন্য কোনো পেশায় পাওয়া যাবে না। বাবার কথামতোই শেষে শিক্ষকতাকে নিজের করে নিলেন। জীবনের শেষ লগ্নে এসে তার  মনে হচ্ছে বাবা ঠিক বলেছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি আনন্দিত এবং গর্বিত। তিনি মনে করেন, তার জন্ম সার্থক হয়েছে। এখন তার একটাই চাওয়া, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়ে যেতে চান।
বিজয় চন্দ্র দে ২৭ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাও আবার যে বিদ্যালয়ের ছাত্র সেই বিদ্যালয়েই।  বর্তমানে ৯৩ বছর বয়স তার। এখনো সেই পেশার সাথেই যুক্ত আছেন। তাঁর হাত ধরেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তিনি যৌবনকালে যাদের পড়িয়েছেন, পড়াশোনায় দিয়েছেন হাতেখড়ি, তাদের ছেলেমেয়েদেরও পড়িয়েছেন তিনি। এখন পড়াচ্ছেন তৃতীয় প্রজন্ম। তাঁর প্রাক্তন ছাত্রদের নাতি-নাতনিদের পড়াচ্ছেন শেষ বয়সে এসে। বর্তমানে স্কুলের যিনি প্রধান শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তিনিও তাঁর ছাত্র। এমনকি স্কুলের সত্তর ভাগ শিক্ষকই তাঁর ছাত্র। তাঁর ছাত্ররা বড় বড় আমলা হয়েছে, বিচারপতি হয়েছে, শিক্ষক, আইনজীবী হয়েছে, হয়েছেন রাজনীতিবিদ। এই বয়সেও বিজয় চন্দ্র দে আগের মতো ইংরেজি ক্লাস নেন। দশম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর তিনটি ইংরেজি ক্রাশ নিতে হয়। টানা ৪০ মিনিট করে তিনি দাঁড়িয়েই ক্লাম নেন।  শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষার ব্যবহার, টেনস্, নাউন-প্রনাউন বোঝান, ইংরেজিতে কথা বলেন অনর্গল। আর ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরাও এই মহান শিক্ষককে পেয়ে উল্লসিত। তাঁর ক্লাসের জন্যে তারা বসে থাকে অধীর আগ্রহে। বিজয় চন্দ্র দে’র মতো বয়সী শিক্ষক সম্ভবত সারা দেশে একজChandpur Teacher Bijoy Candro Day,01নও নেই। আলোকিত এই শিক্ষক নিজেই যেন এক ইতিহাস। এ বছর এ গুণী শিক্ষক ৯৩ বছরে পা দিলেন।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিজয় চন্দ্র দে বলেন, স্বাধীনতার আগে এবং কয়েক বছর পরও দেখেছি তৎকালীন সময়ে পাসের হার ছিলো কম কিন্তু গুণগত শিক্ষা ও শিক্ষার মান ছিলো। বর্তমান সময়ে পাসের হার বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি। এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি পার্থক্য আমার চোখে পড়ে। তা হচ্ছে উন্নয়ন। আগের শিক্ষার্থীকে পায়ে হেঁটে দূর-দূরান্তে গিয়ে পড়তে হতো। এখন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে গেছে। আগেরকার শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বাবার মতো শ্রদ্ধা, গুরুর মতো ভক্তি এবং ভয় করতো। স্যারদের সামনে দাঁড়িয়ে মারপিট তো দূরের কথা কোনো কটু কথা বলতেও সাহস পেতো না। এখন শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা কমেছে। তিনি বলেন, দিন দিন পৃথিবী থেকে শ্রদ্ধা-আন্তরিকতা উঠে যাচ্ছে। শিক্ষকদের মূল্যায়ন সময়ের সাথে সাথে কমে আসছে। শ্রদ্ধা-সম্মান কমছে। অবশ্য তার জন্য শিক্ষকরাও কম দায়ী নয়। এমন কিছু শিক্ষকদের করা উচিত নয় যাতে তার সম্মান ক্ষুন্ন হয়। তবে মূল্যায়ন করে বেশিরভাগ লোকই।
ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রুহুল আমিন হাওলাদার। বিজয় চন্দ্র দে’র সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত গর্বিত বিজয় চন্দ্র স্যারের মতো একজন শিক্ষক এ স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর মতো প্রবীণ শিক্ষক অন্যদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে এখনো ৯৩ বছর বয়সে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে থাকেন। তিনি আমারও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি তাঁর ছাত্র। স্যার প্রতিদিন ৩টি ক্লাস নেন। ইংরেজিতে তিনি অত্যন্ত দক্ষ। শিক্ষার্থীরাও তাঁর ক্লাসের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। সবার কাছে তিনি অভিভাবক, শিক্ষক ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি ড. হাসান খান। তিনি বলেন, বিজয় চন্দ্র স্যার আমারও শিক্ষক। আমি গর্বিত যে তার মতো শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরেছিলাম। তিন প্রজন্ম ধরে স্যার এই স্কুলে পড়াচ্ছেন। সারা দেশে তাঁর হাজার হাজার গুণী শিক্ষার্থী রয়েছে। স্যার এখনো যে পড়াচ্ছেন তা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক বোধ হয় চট্টগ্রাম বিভাগেও একজন নেই।
‘এ বয়সে নিয়মিত ক্লাস নেন। কোনো অসুবিধা হয় কি না –  এমন প্রশ্ন শুনে বিজয় চন্দ্র দে নড়েচড়ে বসলেন। অত্যন্ত দৃঢ কন্ঠে জানালেন, কোন অসুবিধে নেই। শিক্ষার্থীরাই তো আমার প্রাণ। তারা আমার ক্লাস উপভোগ করে। আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। পাঠদান করাই আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো প্রতিদিনি স্কুলে আসার আগে তিনি বাড়িতে হোমওয়ার্ক করে আসেন। স্কুলের ক্লাাশ শেষে বাড়িতে যেয়ে রাতের বেলা নিযমিত পড়াশোনা করেন। পরদিন এসে আবার ক্লাশ নেন। তিনি জানান, তিনি কখনোই প্রাইভেট পড়াতেন না। অনেকের চাপে মাঝখানে কিছুদিন প্রাইভেট পড়ালেও নিজের ইচ্ছেতেই আবার তা বন্ধ করে দিয়েছেন। তার মতে, শিক্ষকরা যদি প্রস্তুতি নিয়ে এসে ক্লাশ করায় এবঙ শিক্ষার্থীরা যদি নিয়মিত ও মনোযোগ দিযে ক্লাশ করে তাহলে আর প্রাইভেট পড়তে হয় না।
বিজয় চন্দ্র দে অবসরে গল্পের বই পড়েন। প্রাপ্তির হিসেব করতে গিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষকতা আমাকে সম্মান, শ্রদ্ধা, বেঁচে থাকার খোরাক সবই দিয়েছে। এ পেশায় এসে আমি পরিতৃপ্ত। কোনো অপূর্ণতা নেই।
বিজয় চন্দ্র দে চার ছেলে ও এক  মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী রেনুকা দে। ১৯৫০ সালে তার বয়স যখন ২৮ বছর তখন তিনি চাঁদপুরের পরিদগঞ্জ উপজেলার কেরোয়া গ্রামের প্রয়াত মনোমহন দত্তের মেয়ে রেনুকাকে বিয়ে করেন। তিনি এখনো বর্তমান। তাদের ছেলে মেয়ে সবাই যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এক ছেলে তাঁরই কর্মস্থল ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারি হিসেবে কর্মরত।
শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান, তার ডায়াবেটিক নেই তবে প্রশ্রাব নালিতে একটু সমস্যা রয়েছে। দাঁতেও ব্যথা হয় মাঝে মধ্যে। এ ছাড়া আর তেমন কোন অসুবিধে নেই। চলাফেরা ও প্রত্যহিক কাজ স্বাভাবিক ভাবেই করেন। তিনি জানান, তিনি কোন ধরনের মাংস খান না। মাছ এবং শাক-সব্জিই বেশি খান। তার খাবারে তেল ও মশলার আধিক্য থাকে না। প্রক্রিয়াজাত খাবার পারতপক্ষে তিনি খান না। রাতে সাড়ে ১০ টার ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল সাড়ে ছ’টার ভেতর ঘুম থেকে উঠে ১৫ মিনিটের মত হাঁটেন। তারপর  একটু চা পান করে গোসল সেরে নেন। সকালে বাত খেয়ে বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বিদ্যালয়েই থাকেন। দুপুরে হালকা নাস্তা সেরে নেন বিদ্যালয়েই। তারপর রাতে বাড়ি ফিরে আবার রাতের খাবার খান। তিনি জানান, নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চললে এবং খাবার গ্রহনে সচেতন হলে যে কোন মানুষই সুস্থ্য থাকতে পারে।  বিজয় চন্দ্র দে ১৯৮৯ সালে সরকারি নিয়ম অনুয়ায়ি চাকুরি থেকে অবসরে যান। তিনি টানা ৩২ বছর ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দাযিত্ব পালন করেন। তার শিক্ষকতা জীবনে তিনি ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়া ফরিদগঞ্জের প্রত্যাশী এ আর উচ্চ বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন ৭ বছর। তবে আবার ফরক্কাবাদেই ফিরে আসেন। অবসরের পর ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাকে অনুরোধ করে, তিনি যেন ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজির ক্লাশগুলো নেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো নিয়মিত ক্লাশ করাচ্ছেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাকে তাদের পক্ষে প্রদেয় সম্মাণ এই শিক্ষককে দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশা করছে, এই শিক্ষক যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তাদের বিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন। বিজয় চন্দ্র দে ৯৩ বছর বয়সেও স্বাবলম্বি। তিনি তার সন্তানদের বোঝা নন। এই বয়সেও নিজের মেধা ও ঘামে উপার্জিত অর্থে নিজের এবং তার স্ত্রীর ভরনপোষন করে যাচ্ছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top