সকল মেনু

কিংবদন্তী হয়ে উঠার পথে একজন ‘সাকিব আল হাসান’!

Sakib 01ক্রিড়া প্রতিবেদক : দাদা তাকে গল্পের ছলে প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি বড় হয়ে বিখ্যাত হবে, পৃথিবীর সবাই তোমাকে চিনবে। যখন তুমি নিজ শহরে আসবে সবাই তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে আর হাততালি দেবে।’

তার দাদা যখন এমনটা বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তিনি তা ঠাট্টা করেই বলেছিলেন। কিন্তু সেই ছোট্ট মানুষটি সেই কথাকেই আজ সত্যতে পরিণত করেছেন। আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সেরা ক্রিকেটার সেই দিনের সেই ছোট্ট বালক। তিনি আজ বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ। আমরা যার কথা বলছি, তিনি ‘সাকিব আল হাসান’।

২৭ বছর বয়সী সাকিব যখন নিজ গ্রামে যান সত্যিই তিনি এলাকার মানুষের করতালিতে প্রশংসিত হন, এমন সন্তানের জন্য গর্বিত হয় নিজ জেলা মাগুরা। সাকিবও শ্রদ্ধায় বিনম্র হন তাদের প্রতি।

২০১২ সালে সাকিবের বিয়ের অনুষ্ঠান কয়েকটি টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। টিমমেটদের কাছেও তিনি তখন অনেক বড় তারকা। তিনি আজ এতোটাই বড় তারকা যে, সাকিব মনে করতে পারছেন না, কবে তিনি সর্বশেষ রাস্তায় নির্বিঘ্নে হেঁটেছিলেন যেখানে ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরবে না।

টেস্টের এক ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়ে ইতিমধ্যে সাকিব নিজেকে বসিয়েছেন দুই গ্রেট ইয়ান বোথাম ও ইমরান খানের পাশে। এ সপ্তাহেই সাকিব নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই তিনি এখন নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার। কিন্তু এতসব রেকর্ডের বাইরেও সাকিব বিশেষ কিছু।

Sakib  02অস্ট্রেলিয়ার বিগ-ব্যাশে এবার সাকিব দারুণ মাতাচ্ছেন দর্শকদের। বলে-ব্যাটে দারুণ সরব এ অলরাউন্ডার। মেলবোর্ন রেনিগেডস-এর সমর্থকদের মতে, ব্যাটে ফিঞ্চের মতো আর বলে ব্রাভো’র মতো দলকে সেবা দিচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ ম্যাচে সাকিব ব্রিসবেন হিটের বিপক্ষে ১৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন।

১৬ কোটি জনসংখ্যার ও বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশের কোনো ক্রিকেটারের জন্য এমন কীর্তি এতদিন ছিল সুদূরপরাহত।

১ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার ঢাকায় সাকিবের ঘুরে বেড়ানো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার রাস্তায় খুব বেশি বের হই না কিংবা কোনো শপিং মলেও যেতে পারি না। নির্দিষ্ট কিছু রেস্টুরেন্টেই নিয়মিত যাই।’

সরকারি ব্যাংকে চাকুরীজীবীর সন্তান সাকিব ছেলেবেলায় ক্রিকেট থেকে ফুটবলই বেশি পছন্দ করতেন। নিয়মিত সকালে ফুটবল আর বিকেলে ক্রিকেট খেলতেন তিনি।

১৫ বছর বয়স থেকেই দেশের হয়ে খেলছেন সাকিব। তখন থেকেই দলের হয়ে নিয়মিত নিজের কোটার পূর্ণ ১০ ওভার বল করতেন আর ব্যাটিংয়ে উপরের দিকে খেলতেন।

গত একযুগে অনেক কিছুই বদলেছে, সেই সঙ্গে বদলেছেন ছোট্ট সাকিব। টেস্ট-ওয়ানডে-টি টুয়েন্টির র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে পৌঁছে নিজের মধ্যে দায়িত্ববোধ নাকি চাপ কোনটি দেখছেন- এমন প্রশ্নে সাকিব দায়িত্ববোধকেই বেছে নিলেন।

সাকিব বললেন, ‘আপনি যখন কোনো একটি বিষয় উপভোগ করছেন, তাকে চাপ বলতে পারেন না, আমি খেলাটাকে উপভোগই করি।’

এমন অলরাউন্ডারদের হাত ধরেই বিকশিত হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট, নিজেদের প্রমাণ করছে বিশ্বমঞ্চে।

Sakib 03২০১৪ তে নিষেধাজ্ঞার ফলে সাকিব-বিহীন বাংলাদেশ টানা ১৩ টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে হেরেছে। টি- টুয়েন্টি বিশ্বকাপে হংকংয়ের মতো দলের কাছেও বাজে ভাবে হারার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। এ ব্যাপারটি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক দিন তাড়া করে ফিরবে।

দলের কোচ চন্দ্রিকা হাথুরু সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দল থেকে বাদ পড়ার বিষয়ে সাকিব বলেন, ‘ব্যাপারটি আমার এবং দলের জন্য খুবই কঠিন ছিল। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে সুযোগ থাকার পরও আমরা ভালো কিছু করতে পারিনি। কয়েকটি খেলায় জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও জিততে পারিনি আমরা। সর্বোপরি সে সময়টা আমাদের পক্ষে ছিলো না। তবে এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে অসাধারণ খেলেছি আমরা।’

গত জুলাইয়ে সাকিবের সমালোচনায় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছিলেন, ‘তার আচরণে মারাত্মক সমস্যা আছে।’

এ বিষয়টি এবং কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তাকে ক্রিকেট থেকে বিরত রেখেছিল প্রায় ৬ মাস। এমন ঘটনা কালো দাগ ফেলেছে সাকিবের ‘ডিসিপ্লিনারি রেকর্ডে’।

এছাড়া, ২০১৩ এর মে মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক দিনের ম্যাচে আম্পায়ারের দেওয়া সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ম্যাচ ফি’র ৭৫ শতাংশ জরিমানা গুনেছিলেন সাকিব।  ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে টিভি ক্যামেরার সামনে বাজে অঙ্গভঙ্গি করে সাকিব তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।

এ শাস্তির পর কেউ কেউ বলেছিলেন, সময়ের অন্যতম সেরা এ ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে বিসিবি একটু বেশিই খড়গহস্ত হয়েছিল।

হাথুরু সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নিষিদ্ধ থাকায় সাকিব কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়েও খেলতে পারেননি। ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দারুণ এক সিরিজ খেলেছেন সাকিব। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সাকিব সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৪ উইকেট নিয়ে ধুঁকতে থাকা দলকে চমৎকার জয় এনে দিয়েছিলেন।

Sakib 04এর পরপরই একই দলের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে সাকিব ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়ে ইমরান খান ও ইয়ান বোথামের পাশে নিজের নাম লেখান। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের পর সাকিবের ঝুলিতে জমা পড়ে ১৮ উইকেট ও ২৫১ রান। যার মাধ্যমে তিন ম্যাচ সিরিজে অল-রাউন্ডিং পারফরম্যান্সে অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসনকে পেছনে ফেলেন সাকিব। তিন ম্যাচে জনসন ১৫ উইকেটের সঙ্গে করেছিলেন ২৫০ রান।

যদিও সাকিবের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি জিম্বাবুয়ের মতো দুর্বল দলগুলোর সঙ্গেই ভালো করে থাকেন; তবে এটাও সত্য যে, তিনি খেলেছেন এমন সব টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষেই ৫ উইকেট নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে সাকিবের। পাশাপাশি আছে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সেঞ্চুরিও।

২০০৬ সালে ২০ বছর বয়সে সাকিবের অভিষেকের পর বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো টেস্ট না খেলায় তাদের বিপক্ষে তার কোনো টেস্ট রেকর্ড নেই।

বাঁহাতি এ স্পিনার ও ব্যাটসম্যান জানালেন, কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। যদিও ক্রিকেটের ‘শিডিউল রেস্ট্রিকশনের’ যাঁতাকলে বড় দলগুলোর বিপক্ষে নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করতে পারেননি সাকিব।

যে কোনো প্রতিযোগিতাকেই ভালোবাসেন তিনি। তবে নিজেদের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি কখনোই। বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি সেখানে প্রায় প্রতিবারই খেলি, কিন্তু খুব ভালো করতে পারি না।’

আরও জানালেন, চ্যালেঞ্জ হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই পছন্দ করেন তিনি। এটিই তাকে প্রতিনিয়ত ভালো করতে উৎসাহিত করে।

নিজেকে প্রমাণের জন্য বিশ্বকাপকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই দেখছেন সাকিব। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্রমাগত ভালো করছি, বিশ্বমঞ্চে দল হিসেবে পারফর্ম করার এটি একটি অনবদ্য সুযোগ।’

২০০৭ সালের বিশ্বকাপের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেবার আমরা ভারত ও দ. আফ্রিকাকে হারিয়েছিলাম।’ আরও জানান, ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মধুর জয়ের কথা।

দেশের ক্রিকেট নিয়ে দারুণ আশাবাদী সাকিব। বলেন, ‘এ বছর আমরা চারটি বড় দল- পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও দ. আফ্রিকার বিপক্ষে হোম টেস্ট সিরিজ খেলব।’ এ সিরিজগুলো টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের প্রমাণে ভালো সুযোগ করে দিবে বলেই ভাবছেন সাকিব।

দলের সম্পর্কে সাকিব বলেন, ‘আমি মনে করি এই মুহূর্তে আমাদের দলটি বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সেরা দল। যদিও এবারের বড় দলগুলোর বিপক্ষে খেলাটা আমাদের জন্য খুব সহজ হবে না, তারপরও আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত ও ভালো খেলার ব্যাপারে আশাবাদী। নিজেদের দেশে আমরা খুবই শক্তিশালী এবং যেকোনো দলের বিপক্ষে জয়ের সামর্থ্য রাখি।’

সূত্র: বিগব্যাশ ডট কম

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top