সকল মেনু

ভালো নেই সুন্দরবনের শুঁটকি পল্লীর ২৫ হাজার জেলে

  সুন্দরবনের শুঁটকি পল্লী থেকে ফিরে,শওকত বাবু : বঙ্গোপসাগর উপকুল বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের দুবলাসহ ১১ টি শুঁটকি পল্লীর ২৫ হাজার জেলে-বহরদ্দাররা ভালো নেই। নেই তাদের নিরাপদ আশ্রায়স্থল, সুপেয় পানি ও চিকিৎসাসেবা। সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায় বনদস্যু আতঙ্ক। বছরের পর বছর ধরে শুঁটকি পল্লীর জেলে বহরদ্দার জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে দেশের জন্য শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও তাদের ভাগ্য বদলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি। সংসদীয় কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় কালে জেলেরা এ সব কথা  জানান।

জেলেদের সার্বিক বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে প্রথমবারের মত মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ৩ দিনের সফরে সুন্দরবনের শুঁটকি পল্লীতে যান। ভারত ও মিয়নমারের কাছ থেকে সমুদ্র বিজয়ের পর সরকার বিস্তৃত সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দ সুন্দরবনের শুঁটকি পল্লী পরিদর্শন ও আলোরকোলে জেলেদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

আলোরকোল শুঁটকি পল্লীর বহরদার গাজী গোলাম রসুল বলেন, ‘আমি ১৯৮১ সাল থেকে সুন্দরবনে এই শুঁটকি পল্লীতে থেকে জেলেদের দিয়ে সাগরে মাছ আহরণ করে আসছি। আমরা হাজার হাজার জেলে ও ব্যবসায়ীরা বন বিভাগকে নির্ধারিত রাজস্ব দিয়ে এই চরে অবস্থান নেই। সিডর ও  আইলার মত বড় বড় দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ আহরণ করে থাকি। অথচ সরকার আসে সরকার যায় আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। নেই কোনো ঘুর্ণিঝড় আশ্রায় কেন্দ্র। কারিতাসের তৈরী চারটি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে দুটি এখন পরিত্যক্ত। সেখানে কথা হয় জেলে নুরমোহাম্মদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘কি কমু ভাই আমাদের ভাগ্যের কথা। বৌ-ছল-মাইয়া রাইখ্যা সাগরে মাছ ধরতি আসি। বনে বাঘ, পানিতে কুমির, ঝড়-বণ্যা মাথায় নিয়া প্রায় ১৬ বছর ধইরা পেটের টানে মাছ ধরছি। তারপরও ডাকাইতের অত্যাচার। কোথায় যাব বাব দাদার আমল থেকে জেলে হিসেবে কাজ করে আসছি। খাবার পানি সমস্যা ও জ্বরজারিসহ অসুখ ওইলে কেউ দেখার নেই। মোগো দাবি সরকারের কাছে যাতে মোরা অসুধসহ ডাক্তার পাই-পুকুরের খাবার পানি পাই। ঝড় অইলে থাকার ব্যবস্থায় চাই।’

দুবলা ফিসারম্যান গুপের কো-চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বলেন, ‘সুন্দরবনের শুঁটকি পল্লী এলাকার ১৯ টি চরে কমপক্ষে একটি করে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ও পুকুর খনন করা জরুরি। শুঁটকি মৌসুমের জন্য সার্বক্ষণিক ওষুধসহ একজন সরকারি ডাক্তার প্রয়োজন। বনদস্যুদের অপতৎপরতা ও গভীর সমুদ্রে ভিন দেশি জেলেদের অনুপ্রবেশ রোধে সার্বক্ষণিক কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর জনবল বাড়িয়ে নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন।’

মতবিনিময় কালে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জেলেদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। তবে সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সমুদ্রে মৎস আহরণে তিনি সকলের সহযোগিতা আশা করেন।

প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকে ৫ মাসব্যাপী চলে সুন্দরবন উপকুলে শুঁটকি আহরণ। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ থেকে নির্ধারিত রাজস্ব পরিশোধ করে পাস-পারর্মিট নিয়ে ডিপো মালিক, বহরদারসহ এ সব জেলেরা শুঁটকি আহরণে যায়। বঙ্গোপসাগরসহ বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে কমপক্ষে ১৭টি বনদস্যু বাহিনীর মুক্তিপণের দাবিতে জেলে ও বনজীবীদের অপহরণ বাণিজ্যের কারণে আতঙ্কে থাকতে হয় জেলে, বহরদার ও ডিপো মালিকদের। দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বনদস্যুদের উৎপাত আশঙ্কার মধ্যেও জীবন জীবিকার তাগিদে সাগর পাড়ের চরাঞ্চালে অবস্থান নেয় এ সব হত দরিদ্র জেলেরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, গত মৌসুমে পল্লীর জেলেদের আহরিত ২৫ হাজার ২শ’ ৩৮ কুইন্টাল শুঁটকি মাছ থেকে সুন্দরবন বিভাগের রাজস্ব আয় করে ১ কোটি ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকা। গত শুঁটকি মৌসুমে ৫৫ জন ডিপো মালিক, ১৩ জন বহরদার, ৮৯৫টি জেলে ঘরে থেকে প্রায় ২৫ হাজার জেলে শুঁটকির জন্য মাছ আহরণ করে। এ বছর সুন্দরবনের ১১টি চরে শুঁটকির জন্য মাছ আহরণে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে ১১৫ জন ডিপো মালিক, ১২ জন বহরদার, ৩ হাজার ৪শ’টি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করছে। সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি  মৌসুমকে ঘিরে সুন্দরবনের দুবলার চর, মেহেরআলীর চর, আলোরকোল, অফিসকিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, চাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদাখালী চরে অবস্থান নেয় এ সব জেলে ও বহরদ্দাররা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top