সকল মেনু

অবশেষে স্বেচ্ছায় অবসরে গেলেন স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজউদ্দিন

 নিজস্ব প্রতিবেদক : শুধু মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি নয়, নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের বরপুত্র ছিলেন স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া। প্রশাসনের দাপুটে এই কর্মকর্তা যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির বলয়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগ ওঠা স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে  জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়াজ উদ্দিন মিয়া ১৯৯৫ গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকাকালীন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় গোপালপুর আদর্শ গ্রাম প্রকল্পের কাজে ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য তদন্ত কমিটি অর্থ আত্মসাৎ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। তবে তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমান জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তাকে সতর্ক করা হয়, যা তার সার্ভিস বইয়ে (পিডিএস) লেখা আছে।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ১০টি পদে শতাধিক লোক নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্যের তকমা লেগেছে এই সচিবের গায়ে। কমিটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেই চূড়ান্ত করেছিলেন ১১৩ জনের নিয়োগ। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি করে দেয়। তদন্তে মিলে অভিযোগের সত্যতা।

পরে বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে, নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে পুরোপুরি তদন্ত করার অনুরোধ করে পূর্ত মন্ত্রণালয়। এরপর দুই বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু আজও নিয়াজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্বেচ্ছায় অবসরের জন্য আবেদন করা স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর কিছুতেই দমে যাননি। বরং যেখানেই গেছেন, সেখানেই বিতর্কের বোঝা চেপেছে তার ঘাড়ে। ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি)। সেখান থেকেও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে ফিরতে পারেননি নিয়াজ উদ্দিন।

পরিবার পরিকল্পনার অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘নিয়োগ, পদোন্নতি ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও বাণিজ্যের কারণে এই অধিদপ্তরে এক সময় নিয়াজ উদ্দিন মিয়ার নামও কেউ শুনতে পারতেন না। পত্র-পত্রিকাতেও এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সবচেয়ে বড় অনিয়ম হয়েছে মাঠকর্মী নিয়োগে। অধিদপ্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, স্থবির হয়ে পড়েছিল পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম।’

এত অভিযোগ কাঁধে নিয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তার সচিব পদ পাওয়া রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল প্রশাসনে। তবে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়ে লেজেগবরে অবস্থায় পড়েন স্বাস্থ্যসচিব। চাকরির মেয়াদ বাড়তে তিনি এই ভুয়া সনদ নেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে আসে।

সনদ বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই কাজ করায় কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে  গত ১৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়াজ উদ্দিনসহ চারজনকে কারণ দর্শাতে বলে। এরপর ২৮ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শোকজ জবাব দেওয়ার ১০ দিনের মাথায় বৃস্পতিবার স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করেন স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজউদ্দিন মিয়া। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জালিয়াতি প্রমাণের পরও অভিযুক্ত সচিবরা কীভাবে এতদিন পদে বহাল ছিলেন, তা বিস্ময়ের। জনপ্রশাসন চাইলে কি তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারত না?’

স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করা স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নোটিশের জবাব নির্ধারিত সময়েই তিনি দিয়েছেন। কোনো ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, ‘দোষ প্রমাণের পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্লিপ্ততার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানো হলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তা ছাড়া অধীনস্থরাও ঊর্ধ্বতনদের ওপর সম্মান হারাবেন। এই সংস্কৃতি কখনোই সুশাসনের জন্য সহায়ক হতে পারে না।’

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে ১২টি মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। নিয়মের বাইরে গিয়ে একাডেমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে চারটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদনে দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন কমিটির সভায় প্রস্তাব না তুলেই ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিতে।

কলেজগুলো হচ্ছে- রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ, গুলশানের ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ, নারায়ণগঞ্জের ইউএস-বাংলা ও রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ। মেডিক্যাল কলেজগুলো অনুমোদনে মন্ত্রীসহ ১২ সদস্যের কমিটির আটজনই সই করেননি। অনিয়মের অভিযোগ আছে মহাখালীর ইউনিভার্সাল, চট্টগ্রামের মেরিন সিটি, সিলেটের পার্ক ভিউ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল, খুলনার সিটি ও আদ-দ্বীন-আকিজ মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদনের ক্ষেত্রেও।

নিয়ম না মেনে গড়ে তোলা এসব বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন বাতিলের ব্যাপারে সরব হয়েছিল চিকিৎসক সমাজ। সরকারকে চিঠি দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিলের দাবি জানায় চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ১২টি মেডিক্যাল কলেজের কাজ স্থগিত করে বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ আছে নিয়াজ উদ্দিন মিয়ার বিরুদ্ধে।

মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ৯টি জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ চরম অনিয়ম হয়েছে। পরীক্ষা নিতে খরচ হয়েছিল প্রায় দুই কোটি টাকা। অথচ পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেই চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা জনপ্রতি ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম উল্লেখ করে ভুক্তভোগীরা হাইকোর্টে রিট করলে নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। এই নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান সচিব  নিয়াজ উদ্দিন মিয়া জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

সদ্য স্বেচ্ছায় অবসরের জন্য আবেদন করা স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন অবশ্য এ বিষয়ে তার কোনো দায় স্বীকার করতে চান না। তিনি বলেন, ‘যা করার করেছে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। আমি তো আর সে কর্তৃপক্ষ ছিলাম না। তা হলে আমার ওপর কেন দায় আসবে?’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top