সকল মেনু

রায় ফাঁস: অভিযুক্ত সাকার স্ত্রী-ছেলে

 নিজস্ব প্রতিবেদক,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ফাঁসের অভিযোগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী, ছেলে ও আইনজীবী ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলামসহ সাতজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মো. শাহজাহান ওই চার্জশিট দাখিল করলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাবরিনা আলী আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর তা আদালতে উপস্থাপনের আদেশ দেন।

চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, আইনজীবী ফখরুল ইসলাম, ফখরুলের সহকারী মেহেদী হাসান, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল আহসান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী নয়ন আলী ও ফারুক হোসেন।

এদের মধ্যে নয়ন আলী, ফারুক হোসেন, ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম, মাহবুব আহসান জেলহাজতে আটক আছেন। বাকিরা পলাতক।

আদালতে এ মামলার সংশ্লিষ্ট সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আগামী ধার্য তারিখে নিয়মানুযায়ী আদালত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে হুলিয়া ও মালক্রোকের আদেশ দিতে পারেন। এরপর পলাতক আসামিদের আদালতে হাজির হতে পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিবেন আদালত।

এরপর মামলাটি মহানগর দায়রা জজ আদালত ঘুরে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে যাবে বিচারের জন্য।

মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ও তার পরিবারের সদস্যরা রায়ের আগেই রায় ফাঁসের অভিযোগে মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকলে সারা দেশে হৈচৈ পড়ে যায়।

এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাদী হয়ে ২ অক্টোবর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন।

এছাড়া ৪ অক্টোবর ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান বাদী হয়ে ঢাকার শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে ছিলেন।

মামলা থেকে জানা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের দিন রায় ঘোষণার পূর্বেই তার পরিবারের সদস্যরা ইন্টারেনেটের মাধ্যমে রায়ের কপি পেয়ে গেছেন উল্লেখ করে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

ওইদিন তারা রায়ের স্পাইরাল বাইন্ডিং কপি মিডিয়াতে প্রদর্শন করেন এবং সেটি নিয়েই তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করেন।

ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার পূবেই রায়ের কপি কীভাবে ইন্টারনেটে প্রকাশিত হল সেই রহস্য উদ্‌ঘাটন করার জন্য ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এটিএম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহবাগ থানায় জিডি করেন।

জিডির সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করে ডিবি পুলিশ। এরপর ওই বছরের ২০ নভেম্বর বেলা ৩টা ২০ মিনিটে রাজধানীর সেগুন বাগিচার নিজ চেম্বার থেকে এ মামলার অন্যতম আসামি ব্যারিস্টার ফখরুলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

এদিকে রায়ের কপি ফাঁসের ঘটনায় আটক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অস্থায়ী কর্মচারী নয়ন আলী ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়ার কাছে জবানবন্দি দেন।

নয়নের জবানবন্দিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার ও ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালের অফিস সহকারী ফারুক আহমেদ জড়িত বলে প্রকাশ পায়।

স্বীকারোক্তিতে নয়ন জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে কথা বলার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম নিজ হাতে তাকে সিম্ফনি এক্সপ্লোরার মোবাইল ফোন দিয়ে ছিলেন।

নয়ন স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বরের ৩/৪ দিন আগে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী ফারুক তার কাছে সাকা চৌধুরীর মামলার আদেশের তারিখগুলো চাইলে তিনি জানান মূল ফাইল স্যারের (বিচারপতি) বাসায় তাই কীভাবে দেব।

পরে ফারুক কম্পিউটার থেকে এনে দিতে বলে। নয়ন ওইদিন কম্পিউটার থেকে একশটা আদেশ ও সাকা চৌধুরী নামের ফোল্ডার বাছাই করে রাখেন।

ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামের জুনিয়র মেহেদী হাসান এবং ফারুক তার ২ দিন পর তাকে খাবার রুমে ডেকে নিয়ে একটি পেনড্রাইভ দিলে তা এনে দেন। ওইদিন রোববার ছিল।
ফারুক তখন মেহেদীকে বলেন, ‘টাকা কই?’ মেহেদী বলেন, ‘টাকা আনি নাই।’ তখন ফারুক নিজ পকেট থেকে নয়নকে ৫০০ টাকা দেয়। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নয়ন চা খেতে আসলে মেহেদীর সঙ্গে দেখা হয়। কাজ না থাকলে মেহেদী তাকে চেম্বারে যেতে বললে ব্যারিস্টার ফখরুলের কাকরাইলের চেম্বরে যায়। চেম্বারে যাওয়ার পর মেহেদী ব্যারিস্টার ফখরুলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে ব্যারিস্টার ফখরুল ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে তাকে ৫০০ টাকা দেন।

নয়ন আরো জানায়, টাকা দেয়ার পর মেহেদী বাইরে এসে ওইদিন তাকে আরেকটি পেনড্রাইভ দিয়ে বলেন ‘আরেকদিন বাকী আদেশগুলো নিয়ে আসবেন।’ এর দুই দিন পর বেঞ্চ অফিসার গৌরিচন্দ্র তার বেতনের স্ট্রেটমেন্ট টাইপ করতে বলেন। ট্রাইপকরাকালে তিনি দেখতে পান সাকা চৌধুরী নামে যে ফোল্ডারটি তিনি মেহেদীকে দিয়েছেন তাতে রায়ের কপি আছে।

এরপর ব্যারিস্টার ফখরুলের চেম্বরে গিয়ে মেহেদীকে রায় ডিলেট করতে বললে মেহেদী জানায়, ডিলেট করা যাবে না, ফখরুল সাহেব ডিলেট করতে নিষেধ করেছেন। এরপর ব্যারিস্টার ফখরুলের কাছে গেলে সেখানে থাকা সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘রায়ের বাকী অংশ এনে দিবি না দিলে জানে মেরে ফেলব।’ সঙ্গে ব্যারিস্টার ফখরুলও তাকে হুমকি দেন। পরে তিনি ভয়ে চলে আসেন। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর আবার চেম্বারে গেলে মেহেদী তাকে ব্যারিস্টার ফখরুলের কাছে নিয়ে যায়।

ব্যারিস্টার ফখরুল তাকে বলেন, ‘নয়ন তুমি তো আমাদের অনেক উপকার করেছো। তোমার কি আনরেজিস্ট্রার্ড সিম আছে?’ আছে জানালে তখন ব্যারিস্টার ফখরুল তাকে একটা সিম্ফনি এক্সপ্লোরার মোবাইল ফোন দিয়ে বলেন, ‘ওই সিম এই মোবাইলে ভরে শুধু মেহেদীর সঙ্গে কথা বলবা।’

নয়ন আরও জানায়, এরপরও প্রায় ৪ থেকে ৫ দিন ধরে সাকা চৌধুরীর মামলা নিয়ে যা টাইপ হতো তা তিনি পেনড্রাইভে করে মেহেদীকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিয়েছেন। ১ অক্টোবর রায়ের দিন বেঞ্চ অফিসারের মুখে শুনতে পান রায় অনলাইনে প্রকাশ হয়ে গেছে। শুনে তিনি মেহেদীকে ফোন দিলে চেম্বারে যেতে বলেন।

চেম্বরের যাওয়ার পর মেহেদী জানায়, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার ও তার পরিবারের লোকজন ওই কপি নিয়ে গেছে। ওরাই হয়তো এটা অনলাইনে দিয়েছে।

নয়নকে চিন্তা না করতে বলে মেহেদী বলেন, ‘ওরা দিয়ে থাকলে ওদের কাছ থেকে তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে দেব।’

চলে আসার পর বিকেলে মেহেদী তাকে ফোন করে আর যোগাযোগ করতে নিষেধ করেন। সেই সঙ্গে মেরে ফেললেও তাদের নাম বলতে নিষেধ করেন। এরপর বেঞ্চ অফিসার অফিসে ডাকলে সে ঘটনা বলে দেয়।

চার্জশিটেও নয়ন আলীর ওই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য এসেছে। মেহেদী হাসান নয়ন আলীকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন।

নয়ন আলীর জবানবন্দির ভিত্তিতেই ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মর্মে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়, আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ ও দেশ-বিদেশে বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করতেই কৌশলে রায়ের কপি সংগ্রহ করে তা এমএস ওয়ার্ড থেকে পিডিএফ এ রুপান্তর করে www.traibunalleaks.be  নামক অনলাইনে প্রকাশ করেন।

এ অপরাধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৪ (২), ৫৭(২), ৬৩ (২) ও ৬৬ (২) ধরায় ঢাকার আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। চার্জশিটে ২৫ জনকে সাক্ষি করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top