সকল মেনু

দুদকের ফাইলে আলোচিত সাবেক ছয় মন্ত্রী-এমপি

মেহেদি হাসান,হটনিউজ২৪বিডি.কম: অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ফাঁসছেন বর্তমান ও সাবেক ছয় মন্ত্রী-এমপি। প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধানে তাদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্রে জানা যায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আমলে নিয়ে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অভিযুক্তরা হলেন রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ এনামুল হক, কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদি, ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হক, পটুয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ (সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী) মাহবুবুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক ও সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান। এদের মধ্যে কক্সবাজার-৪ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদির সম্পদের অনুসন্ধান কর্মকর্তা আবদুস সোবহান পরিচালক নূর আহাম্মদের (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত) কাছে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। যা যাচাই-বাছাই শেষে শিগগিরই তা কমিশনে পেশ করা হবে। বদির বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য কমিশনের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। কমিশনের অনুমোদনক্রমে শিগগিরই কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় মামলা করবে দুদক।

সূত্র আরো জানায়, দুদকে দাখিলকৃত বদির সম্পদ বিবরণী ও আয়কর নথিগুলো যাচাই-বাছাই শেষে বেশ গরমিল পাওয়া গেছে। আয়কর নথিতে রয়েছে, তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফান্ডে ৫০ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু ৫০ লাখ টাকার কোন রসিদ কিংবা কোন খাত থেকে ওই টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো নথি জমা দেওয়া হয়নি। এমনকি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদেও এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য দিতে পারেনি আবদুর রহমান বদি।

বদির সম্পদের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, বদির নামে কক্সবাজার সার্কিট হাউস রোডে ১২ তলা একটি ভবন রয়েছে, যা ২৫ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে। পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা ব্যয় করে দ্বিতীয় স্ত্রী খাদেজা আকতার শাকেরুন্নেছা শাকীর নামে কক্সবাজার শহরে নির্মাণ করা হয়েছে ছয়তলা আরেকটি ভবন। রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে সাততলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি ও বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পে তিনটি প্লট রয়েছে তার নামে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে বদির মালিকানাধীন পাঁচটি জাহাজ চলাচল করে। প্রতিটি জাহাজের মূল্য অন্তত পাঁচ কোটি টাকা হবে।

এভাবে বদির নামে-বেনামে তার ৫০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্রে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে ইয়াবা ব্যবসা করেই তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন।

সাংসদ বদির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামা অনুসারে গত পাঁচ বছরে আয় বেড়েছে ৩৫১ গুণ। এই সময়ে অর্জন করেছেন ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০ টাকা। বার্ষিক আয় ৭ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮০৮ টাকা ও বার্ষিক ব্যয় ২ কোটি ৮১ লাখ ২৯ হাজার ৯২৮ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুদকে পেশ করা সম্পদ বিবরণীতে সমুদয় সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় মাত্র ২০ কোটি টাকা।

এদিকে পটুয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ ও সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন বর্তমানে দুদক পরিচালক নূর আহাম্মেদের নিকট রয়েছে। যা যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনে যাবে চলতি সপ্তাহে। সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর অঢেল সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া দুদক কর্মকর্তা কমিশনের কাছে মামলার অনুমতি চেয়েছেন।

দুদক সূত্রে জানা যায়, নিজের ও তার বড় ভাই মাহফুজুর রহমানের দুটি মিনিবাস কাউন্টারের ইনচার্জ থেকে তিনবারের সাংসদ সাদামাটা জীবনযাপন থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছেন। ২০০৮ সালে পটুয়াখালী-৪ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। তার পর থেকে শুরু তার বিলাসী জীবন। স্ত্রী প্রীতি হায়দারের মালিকানায় দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে মন্ত্রণালয়ের কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে এবং কমিশন হাতিয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী, তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে শুধুমাত্র তার জমিই পাওয়া গেছে প্রায় দুই হাজার একর। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

প্রীতি রহমান নামে দিয়ে তার ‘গঙ্গামতি এন্টারপ্রাইজ’ এবং প্রীতি হায়দার নাম দিয়ে ‘আন্ধারমানিক ট্রেডার্স’ নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি ও কলাপাড়া পৌরসভার কয়েক শ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাগিয়ে নেওয়া হয়। আর এসব টাকায় নিজ এলাকা ও রাজধানীতে গড়েছেন অঢেল সম্পত্তি।

দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, তার নিজের এলাকায় রয়েছে দুটি ইটভাটা। যেখানে পাউবোর কোটি টাকার জমি দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় উত্তরায় চারটি ফ্ল্যাটসহ ঢাকায় একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে একটি কম্পোজিট ফ্যাক্টরি, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রীতি হায়দারের নিজ নামে বাড়ি রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। এসব সম্পদ মাহবুবুর রহমানের হলফনামায় গোপন করা হয়েছে বলেও দুদক সূত্রে জানা গেছে।

সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের সম্পদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনও দুদক উপপরিচালক মো. নাছির উদ্দিন পরিচালক বরাবর জমা দিয়েছেন। অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, তার প্রায় ১০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক।

হলফনামা সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে আব্দুল মান্নান খানের সাকল্যে ১০ লাখ ৩৩ হাজার টাকার সম্পত্তি ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেটা হয়েছে ১১ কোটি তিন লাখ টাকা। আগে তার বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ ৮৫ হাজার টাকা। সেই আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে তিন কোটি ২৮ লাখ টাকায়। পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্বকালে তার সম্পত্তি ১০৭ গুণ বেড়েছে।

সাড়ে ৫ মাসের অনুসন্ধান শেষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সাতক্ষীরা-৩ আসনের এমপি অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হকের বিষয়ে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেবেন বলে জানিয়েছে ‍দুদক সূত্রে জানা যায়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি যে ৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। দুদকে দাখিল করা পুরো পরিবারের সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই করেছেন। অনুসন্ধানে নেমে দুদক রুহুল হকের ব্যাংক, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিস, ডাক বিভাগ, জয়েন্ট স্টক, স্টক এক্সচেঞ্জসহ ২৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দুদক।

আ ফ ম রুহুল হক দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ১৬ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ২০০৮ সালের হলফনামায় স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৬৮৪ টাকা। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৮৫ টাকা। কিন্তু দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছেন, ‘৪৫ লাখ ১৭ হাজার ৯৯২ টাকার বিপরীতে হলফনামায় ভুলবশত ৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে বলে দাবি করেন। পরে এফিডেভিটের মাধ্যমে রিটার্নিং অফিসারের কাছে সংশোধনী দিয়েছি। নির্বাচন কমিশন সেটি গ্রহণ করেছে।’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী বিগত মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে অর্থ-সম্পদ ১০ গুণ বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে।

এনা প্রোপার্টিজের কর্ণধার সংসদ সদস্য এনামুল হকের হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। হলফনামা সূত্রে জানা যায়,২০০৮ সালে শুধু বেতন-ভাতা থেকে তার বছরে আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পরে এখন কৃষি, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা ও পেশা থেকে বছরে তার আয় হয় ৫০ লাখ টাকা।

তার নিজের, স্ত্রীর ও নির্ভরশীলদের মোট ১৬ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাধারণ শেয়ার, তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ পাঁচ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়।  নগদ হিসেবে নিজের ১০ লাখ টাকা ও স্ত্রীর হাতে পাঁচ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। নিজ নামে ব্যাংকে আছে আট লাখ ৫৮ হাজার ৯১ টাকা ও স্ত্রীর নামে এক লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা।

অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক যতন কুমার প্রতিবেদন তৈরি কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। দুদক সূত্রে জানা গেছে, তিনি মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন শিগগিরই কমিশনে জমা দিতে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া ঢাকা-১৪ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ আসলামুল হকের সম্পদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক শেখ মেসবাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, ‘প্রসিকিউশনের দায়িত্ব পালনে বেশি সময় দিতে হচ্ছে। তাই অনুসন্ধান কাজ ধীরগতিতে এগোচ্ছে। আশা করি চলতি মাসেই প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ করতে পারব।’

আসলামুল হকের দুই হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পাঁচ বছরে স্বামী-স্ত্রীর জমি বেড়েছে ১৪০ একরের বেশি। আর বাড়তি এই জমির মূল্য দেখিয়েছেন এক কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার টাকা, যা অবিশ্বাস্য। পাঁচ বছরে আসলামুল হকের শুধু সম্পদই বাড়েনি, বেড়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতাও। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণি পাস। আর এখন তিনি বিবিএতে (স্নাতক ব্যবসায় প্রশাসন) অধ্যয়নরত বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান হটনিউজ২৪বিডি.কমকে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে (এমপি-মন্ত্রী) অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কমিশনের প্রাথমিক অনুসন্ধানে সম্পদের অসংগতি পাওয়ায় তাদের (এমপি-মন্ত্রী) সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে। যার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। খুব শিগগির অনুসন্ধান দল প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেবে বলে আশা করছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top