সকল মেনু

তারেক মাসুদ : মৃত্তিকা ও মানুষের চলচ্চিত্রকার

 আফিফা জামান: বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে যিনি চলচ্চিত্রকে বিশ্বমানে উন্নীত করেছেন তিনি তারেক মাসুদ। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে আলোচিত নাম। চলচ্চিত্রকার সমাজ ও সময়ের প্রতি কতোটা দায়বদ্ধ এ বিষয়টি তার নির্মিত চলচ্চিত্র দেখে অনুধাবন করা যায়। আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের যে ধারা নির্মিত হয়েছে, একাত্তরের ঘাতক- দালালদের বিরুদ্ধে যে চেতনা-শিখা প্রজ্বলিত, এখানে তারেক মাসুদের অবদান অনস্বীকার্য। ‘মুক্তির গান’-এর মধ্য দিয়ে তিনি যে কথা বলতে চেয়েছেন আজ তা সবাই বলছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তার পুনর্জাগরণের জ্বলন্ত স্বাক্ষর মুক্তির গান।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ দেখেননি এমন মানুষ খঁজে পাওয়া ভার। যেখানেই মুক্তির গান প্রদর্শিত হতো সেখানেই শ্রেণিহীন মুক্তিপাগল মানুষের ভিড় সামলানো দায় হতো। এ প্রসঙ্গে বলতে হলে অবশ্য আরেকজনের নাম বলতে হয়। তিনি মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্দেশে এ দেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গ নেন। `বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা` নামের এই দলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। শিল্পীদের সঙ্গে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। যদিও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি তখন তথ্যচিত্রটি তৈরি করতে পারেননি।

১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই বস্তাবন্দী ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা বংলাদেশের প্রতিটি প্রান্ত ঘুরে বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। লেভিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফুটেজের সঙ্গে সংগৃহীত অন্যান্য উপাদান যোগ করে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। মুক্তির গানের মধ্য দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রের ধরাবাধা ইতিহাস বদলে ফেলতে দারুণভাবে সক্ষম হন। তিনি খ্যাতিলাভ করেন। বিশেষত মুক্তির গানের প্রেক্ষাপট এই সময়ের দর্শকদের ভীষণভাবে আন্দোলিত করে। এ ছবি দেখার সময় মানুষ যেন শিশুর মতো কাঁদতো। কারণ এর বিষয়বস্তু তার কাছে জন্মদাগের মতো। এর আগে তিনি বিশ্ববরেণ্য শিল্পী এস.এম. সুলতানকে নিয়ে ‘আদম সুরত’ নির্মাণ করেন। কিন্তু সাত বছর ধরে তৈরি করা আদম সুরতের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গণে তার সূচনা হলেও মুক্তির গান তাকে পরিচিতি এনে দেয়। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।

পরবর্তীতে তার নির্মাণ করা চলচ্চিত্র  মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬), রানওয়ে (২০১০) তাকে পৌঁছে দেয় খ্যাতির শিখরে। ‘মাটির ময়না’ প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং পুরস্কৃত হয়। শুধু তাই নয়, এডিনবার্গ, মন্ট্রিল, কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে মাটির ময়না প্রদর্শিত হয়। এটি ২০০৩ সালে করাচি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সেরা ছবির পুরস্কার লাভ করে। ২০০৪ সালে ছবিটি ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। একজন বাঙালি চলচ্চিত্রকারের এত দ্রুত এই পরিমাণ সাফল্য গর্বের বটে। যদিও এ তার নিরন্তর কাজের স্বীকৃতি। মাটির ময়না ছবিটি ২০০২ সালে মুক্তি পায়। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বেগের পটভূমিতে তারেক মাসুদের মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্ধৃতি থাকলেও সেগুলো একটি কিশোরের মানবিক অভিজ্ঞতায় প্রকাশিত হয়েছে। মাদ্রাসায় তার শিক্ষক, সহপাঠীদের আচরণ আর পরিবারের সদস্যদের সাথে তার সম্পর্কের ভিতর দিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে। ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। বহিষ্কারাদেশ বাতিল হবার পর ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল এর ডিভিডি ভার্সন প্রকাশিত হয়।

তারেক মাসুদ সর্বশেষ  কাজ করছিলেন নতুন চলচ্চিত্র ‘কাগজের ফুল’ নিয়ে। এই ছবির শুটিং স্পট দেখার জন্য মানিকগঞ্জের ইছামতি নদীর তীরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওর নামক এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় এই মহান চলচ্চিত্রকার ও সঙ্গী খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর নিহত হন। তারেক মাসুদের বিয়োগান্তক প্রয়াণ চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে শোক ও শুন্যতার সৃষ্টি করেছে তা পূর্ণ হওয়ার নয়।

শুধু চলচ্চিত্র নয়, বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে তারেক মাসুদ শিল্প বোদ্ধাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গায় জন্ম নেয়া তারেক মাসুদের শিক্ষা জীবনের শুরুটা ছিল স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। মৃত্তিকা ও মানুষের এই চলচ্চিত্রকারের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে তার জীবন ও কর্মের প্রতি রইল অশেষ শ্রদ্ধা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top