সকল মেনু

সাধারণের অসাধারণ কাব্যচেতনা

আফিফা জামান :‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,থাকি সেথা সবে মিলে-নাহি কেহ পর। পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।’

শিশুসাহিত্যিক, কবি বন্দে আলী মিয়ার আজ ৩৫তম মৃত্যু দিবস। বাংলা ছড়া ও কাব্যসাহিত্যে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি আজও পাঠকের মনে ভাবনার খোরাক জোগায়। কবিতা লিখে তো বটেই এর বাইরে তার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটি সম্ভব হয়েছিল শিশুসাহিত্য চর্চার মাধ্যমে। উপরে উল্লিখিত ছড়াকবিতাটি এ কথার সাক্ষ্য দেয়।

বন্দে আলী মিয়ার জন্ম পাবনা জেলা শহরের রাধানগরে। ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি তার জন্ম। এরপর রাধানগরেই বেড়ে ওঠা। ১৯২৩ সালে তিনি রাধানগর মজুমদার একাডেমি (বর্তমানে আরএম একাডেমি) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা চলে যান। ১৯২৭ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমি থেকে চিত্রবিদ্যায় উত্তীর্ণ হন। এর ঠিক ৩ বছর পর শিক্ষক হিসেবে শুরু হয় তার কর্মজীবন। কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে সেই যে তিনি যোগদান করেছিলেন সেখানে দীর্ঘ ২০ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৫০ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

পেশাজীবনের শত ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি নিরলসভাবে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করেছেন। শুধু তাই নয়, আমরা যদি তার সাহিত্যজীবন পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করেছেন। গীতিকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার এবং অসংখ্য শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবে তাকে আমরা পাই। এর বাইরেও তিনি যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন সেই চিত্রকলাতেও তার অবদান কম নয়। পাশাপাশি তিনি  জীবনীকার ও স্মৃতিকথার কুশলী লেখকও ছিলেন। অর্থাৎ তিনি সমস্ত জীবন বাংলা সাহিত্য ভূবনে আচ্ছাদিত ছিলেন।

কবি জীবনকালে নানা সমস্যা, জটিলতার সম্মুখীন  হয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের সেই দুঃখগাথা তার সাহিত্যজীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি।

তার অসাধারণ লেখনীর মাঝে তিনি তুলে ধরেছেন সমাজের কথা, সমাজের মানুষের কথা। তার দেখা সেই মানুষগুলো একেবারেই প্রান্তিকজন। যারা বেড়ে উঠেছে গ্রামবাংলার প্রকৃতির সান্নিধ্যে। আমরা অনুমান করতে পারি, চিত্রকলায় পড়াশোনার কারণেই এ দেশের প্রকৃতি দেখার মতো চোখ তার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো নিবিড়ভাবে প্রকৃতির সেই মানুষগুলোকে অনুভব করতে শিখেছিলেন।

আরো অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের মতো ব্যক্তিজীবনে তিনি দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ নিয়ে তার অভিযোগ ছিল একথা বলা যায় না। অর্থের অভাবে তিনি একবার মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি বিক্রি করেছিলেন। প্রকাশিত বই সংগ্রহেও তার উদাসীনতা ছিল। এমনও হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে অথচ বইয়ের কোনো কপি তার কাছে নেই। প্রয়োজন হলে পরিচিত কাউকে বলতেন বইটি সংগ্রহের জন্য। সরলমনা সাদাসিধে মানুষ হিসেবেই তিনি সর্বজন পরিচিত ছিলেন। অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। আর্থিক অনটন সত্ত্বেও কারো কাছে কখনও তিনি অর্থ সাহায্য চাননি- এমনই ছিল তার চারিত্রিক দৃঢ়তা। তবে এই অর্থাভাব তিনি শেষ জীবনে অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

কবি বন্দে আলী মিয়াকে অনেকে বিশ্বখ্যাত রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর কারণও অবশ্য ছিল। তিনি মুখে মুখে গল্প বলায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। টলস্টয়েরও  এই গুণ ছিল!

কবি জীবনের শেষ দিকে বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহীর স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সুযোগ পেলেই শিশুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠতেন। তখন কথা বলতেন ছড়া দিয়ে। হাতের কাছে কাগজ-কলম পেলেই তিনি ছড়া লিখতে বসে যেতেন। এভাবেই একদিন লিখে ফেলেন :

‘ঢুলু-ঢুলু আঁখি-এ রাতে কোথায় থাকি?
কিবা করি কিবা খাই;
কোথায় মেজবান- ধারে কাছে কেহ নাই।’

কবি বেতারে কাজ করার সময় ছোটদের আসর ‘সবুজ মেলা’ পরিচালনা করতেন। এ সময় তিনি ‘গল্প দাদু’ নামে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বেতারে ‘ছেলে ঘুমালো’ অনুষ্ঠানের জন্য প্রায়ই তিনি নতুন গল্প রচনা করতেন। প্রথম জীবনে তিনি যখন কলকাতা ছিলেন সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সজনিকান্ত দাস, প্রমথ চৌধুরী, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, এ কে ফজলুল হক, ওস্তাদ জমির উদ্দিন খাঁ প্রভৃতি বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার প্রথম কাব্য ‘ময়নামতির চর’ ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসার বাণীতে শিরোভূষণ করে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবিগুরু নিজে লিখেছেন :

‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে গঙ্গা চরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথায়ও ফাঁকি নেই। সমস্ত স্বরের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস শুদ্ধিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক গ্রাম্য শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’
(২৬ জুলাই ১৯৩২)

কবি বন্দে আলী মিয়ার শিশুতোষ গ্রন্থের সংখ্যা ১০৫টি এবং অন্যান্য বিষয়ে লেখা বই রয়েছে ৩১টি। এর পাশাপাশি তার ৬টি নাটক, ১টি অনুবাদগ্রন্থ,  স্মৃতিকথা ১টি এবং ৩টি সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ রয়েছে।  ‘চোরজামাই’ শিশুতোষ এই বইটি দিয়েই তার প্রথম আত্মপ্রকাশ।

তিরিশ থেকে চল্লিশের দশকের কোনো এক সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসার ফলে কবির মনে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে তিনি গান লেখায় মনোনিবেশ করেন। বিদ্রোহী কবির নির্দেশেই তিনি গীতি আলেখ্য ‘কারবালা’ রচনা করেন। তার গানগুলো সে সময় রেকর্ড কোম্পানি থেকে ধারন করা হয়। এর কিছু আগে প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহম্মদ বন্দে আলী মিয়ার রচিত ‘ওয়াজ মাহফিল’ টুইন রেকর্ডে বাণীবদ্ধ করেন। এটি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার লেখা অনেক নাটকও সে সময় দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। নিজের লেখা নাটিকে কবি শুধু অভিনয়ই করতেন না, নির্দেশনার কাজটিও তিনি নিজেই করতেন।

তিরিশ-চল্লিশের দশকে কবি বন্দে আলী মিয়ার কলকাতা রংমহল থিয়েটার হলে ‘বৌদিদির রেষ্টুরেন্ট’ অভিনীত হলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। প্রায় ৪ মাস কবির রম্য এ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকের সম্মানী দিয়ে তিনি রাজশাহীতে একটি বাড়ী কিনেছিলেন।

১৯৫০-এর পর বন্দে আলী মিয়া ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি তিনি নিজেই বই প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯৬১ সালে ইষ্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স তার পরোক্ষ সম্পাদনায় প্রকাশ করে শিশুতোষ পত্রিকা ‘ময়ুরপঙ্খি’।

কবি বন্দে আলী মিয়া কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিশ কবিকে ১ হাজার টাকা নজরানা দিয়ে সংবর্ধনা দেয়। কবি সে সময় সংবর্ধনা সংখ্যা বের করেছিলেন।  ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে কবির ‘ধরিত্রী’ শিরোণামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির ‘বিদায় প্রহর’ কবিতার অংশ বিশেষ পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।

‘এবারে আমার শেষ হয়ে এলো/প্রবাসের দিনগুলি/
যাবার বেলায় বারে বারে হায়/মন ওঠে তবু দুলি।/
কেটেছে হেথায় কয়টি বছর/সুখে-দুখে বেদনায়/
স্মরণ ভরিয়া রহিল সে সব/ভুলিব না কভু তায়।/
আমার স্মরণে তোমাদের ছবি/জেগে রবে অনুক্ষণ/
বিদায় এবার ফুরায়েছে মোর/প্রবাসের প্রয়োজন।’
(শেষ কবিতা)

অনন্য প্রতিভার অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন। কবির স্মৃতি রক্ষার্থে পাবনায় তার নামে একটি স্মরণ পরিষদ এবং শিশু একাডেমির নামকরণ করা হয়েছে। পাবনা পৌরসভার উদ্যোগে তার নামে একটি সড়ক, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এবং জেলার আটঘরিয়া উপজেলায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জেলাবাসীর দাবি কবির স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারিভাবে আরো কিছু উদ্যোগ নেয়া হোক। যেহেতু তিনি চিত্রশিল্পী ছিলেন, সে কারণে তার নামে পাবনায় একটি চিত্রশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

কবির বসতভিটা ‘কবিকুঞ্জ’ এখন পরিত্যক্ত। বাড়িটির সংস্কার জরুরি। কবি অনুরাগীদের দাবি সংস্কার করে কবির রেখে যাওয়া কর্ম, স্মৃতিগুলো সংরক্ষণের জন্য কবির বাড়িতেই সংগ্রহশালা গড়ে তোলার। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top